‘কেমন আছ, ইদু মিঞা?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘যিমুন দোয়া করছেন, হুজুর।’ বলেই স্টার্ট দিল ইদু মিঞা গাড়িতে। ফাস্ট গিয়ারে দিয়ে ক্লাচটা ছাড়ার কায়দা দেখেই বুঝল রানা, পাখোয়াজ ড্রাইভার।
হঠাৎ চোখ পড়ল রানার দরজায় দাঁড়ানো রাঙার মার উপর। মুখের দিকে চেয়েই বুঝল রানা, অনর্গল দোয়া দরুদ পড়ছে বুড়ি। গত রাতে জিনিসপত্র গোছগাছ করা দেখেই কয়েক রাকাত নামাজ বেড়ে গেছে বুড়ির। সাধে আর মোখলেস ওকে রানার মা বলে খেপায় না। কোথায় যেন ওর মৃত মায়ের সাথে। মিল আছে এই স্নেহময়ী বৃদ্ধার। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়তে যাচ্ছিল, সচেতন হয়ে সামলে নিল রানা।
রাতের বেলা আর সাভারের দিকে যাও না তো, ইদু মিঞা?’
‘তোবা, তোবা। এই জিন্দেগীর মোদে তো আর না। আইজ ষোলো বচ্ছর ডাইবোরি করতাছি, হুজুর, যাই নাইক্কা। আর উই দিনকা যে কী অইলো-হালায়। এউগা পাসিঞ্জার, আমাগো মাহাল্লারই কণ্টেকদার… হঠাৎ থেমে গিয়ে কণ্ঠস্বর নামিয়ে ইদু মিঞা বলল, ‘আপনের পিছে আই.বি. লাগছে, হুজুর!
‘কী করে বুঝলে?’ ঘাড় না ফিরিয়েই জিজ্ঞেস করল রানা।
‘এউগা মার্সিডিচ আইতাছে পিছে পিছে। পুরানা পল্টন থেইকা লাগছে পিছে! খারোন সাব, টাইম তো আছে, সিজিল কইরা দেই হালারে।
হেয়ার রোড দিয়ে বেরিয়ে সাকুরার সামনে উঠে ডান দিকে না গিয়ে বায়ে চলল ইদু মিঞা। রেডিয়ো পাকিস্তান ছাড়িয়ে রিয়ার-ভিউ মিররের দিকে চেয়ে বলল, ‘আইতাছে।
শাহবাগের ঝর্ণাটা চট করে ঘুরেই আবার এয়ারপোর্টের দিকে চলতে থাকল। ট্যাক্সি।
‘চেহারাটা দেইখা রাখেন, হুজুর।
ওয়ান-ওয়ে রোড। আত্মগোপন করবার উপায় নেই। কালো মার্সিডিস বেঞ্জের ড্রাইভিং সিটে গোপদাড়ি পরিষ্কার করে কামানো সানগ্লাস পরা একজন ফর্সা লোক সোজা সামনের দিকে চেয়ে বসে আছে। এক নজরেই রানা বুঝল লোকটা ভারতীয় গুপ্তচর।
যখন সত্যি সত্যিই পিছনের গাড়িটাও ঝর্ণা ঘুরে এয়ারপোর্ট রোড ধরল তখন দ্রুত একটা বালি ভরা ট্রাককে ওভারটেক করে পেট্রল পাম্প ছাড়িয়ে হাতীর পুলের দিকে মোড় নিল ইদু মিঞা। পাওয়ার হাউসের পাশ দিয়ে যেতে বাতাসে ভেসে আসা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণায় সামনের উইণ্ড-স্ক্রিন ঝাপসা হয়ে গেল। ওয়াইপারটা চালু করে দিয়ে প্রায় এক লাফে পার হয়ে গেল পুলটা ইদু মিঞার ট্যাক্সি। পুল থেকে নেমেই ডান দিকে মোড় ঘুরে নানান গলি ঘুচি পেরিয়ে গ্রিন রোডে গিয়ে পড়ল এবার ওরা। তারপর ওখান থেকে সোজা এয়ারপোর্ট।
ফার্মগেটের কাছে এসেই গাড়ি থামিয়ে মিটার ডাউন করে নিল ইদু মিঞা যাতে এয়ারপোর্ট থেকে যে নতুন প্যাসেঞ্জার উঠবে তার ঘাড়ে কিছু পয়সা আগে থেকেই উঠে থাকে।
এয়ারপোর্টে পৌঁছেই রানা দেখল কালো মার্সিডিস বেঞ্জটা নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে আছে NO PARKING লেখা একটা সাইন বোর্ডের নিচে। এত চালাকি খাটল না। দেখে ইদু মিঞার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। চাপা গলায় বলল, হুজুর, নামলেই অ্যারেস করব আপনেরে। অখনও টাইম আছে। কন তো ভাইগা যাই গা।
মনে মনে হাসল রানা। ইদু মিঞা তাকে হয় ক্রিমিনাল, নয় তো কমিউনিস্ট ঠাউরে নিয়েছে। মুখে বলল, না, তার দরকার নেই। ভাল গাড়ি চালাও তুমি, ইদু মিঞা।
দু’জন পোর্টার এসে রানার সুটকেস নিয়ে গেল ওজন করে ট্যাগ লাগাতে। দুটো দশ টাকার নোট বের করে ইদু মিঞার দিকে বাড়িয়ে দিল রানা। আধ হাত জিভ বের করে কয়েকবার মাথা নাড়াল ইদু মিঞা এপাশ-ওপাশ।
‘ট্যাকা দিয়া আমার ইজ্জতটা পাংচার কইরেন না, হুজুর। এর থেইকা দুইটা জুতার বারি মাইরা যান গা। আহত অভিমান ওর কণ্ঠে।
এই সূক্ষ্ম মান-অপমান জ্ঞান সম্পন্ন ঢাকাইয়া কুট্টিকে আর বেশি না ঘটিয়ে ব্রিফিং কাউন্টারের দিকে এগোল রানা। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই বাঁ দিকের টেলিফোন বুদের দরজাটা ফাঁক করে দেখল সেই সানগ্লাস পরা শ্ৰীমান ডায়াল ঘোরাচ্ছে সেখানে দাঁড়িয়ে মাল ওজন করিয়ে আইডেন্টিফিকেশন ট্যাগ এবং টিকেট দেখিয়ে সরু বোর্ডিং পাস নিল রানা।
‘অ্যাটেনশন, ইওর অ্যাটেনশন প্লিজ। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স অ্যানাউন্সেস দ্য ডিপারচার অভ ইটস ফ্লাইট পি-কে ফাইভ টোয়েনটি-ওয়ান টু ঈশ্বরদি। প্যাসেঞ্জারস অন বোর্ড প্লিজ। থ্যাঙ্ক ইয়ু।
খনখনে মেয়েলী কণ্ঠস্বর।
প্লেনে উঠে একটা চেনা মুখও দেখতে পেল না রানা। খুশিই হলো মনে মনে। মাঝামাঝি জায়গায় জানালার ধারে বসে সিট বেল্ট বেঁধে নিল ও, তারপর খুলল রাহাত খানের দেয়া কাগজটা। শুধু একটা লাইন লেখা:
DON’T HESITATE. TO KILL.
আকাশে উঠে গেল ফকার-ফ্রেণ্ডশিপ। হলুদ রোদ বিছিয়ে পড়েছে অনেক নীচে সবুজ মাঠের ওপর।
.
ছোট্ট শহর কুষ্টিয়া। রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই শোচনীয়। তৈরির পর মিউনিসিপ্যালিটি বোধহয় মানুষকে টিকা দিয়েই আর ফুরসত পাচ্ছে না-রাস্তার গায়ে যে স্থায়ী বসন্তের দাগ পড়ে গেছে, সেদিকে লক্ষ্যই নেই। যানবাহনের মধ্যে রিকশাই একমাত্র ভরসা।
খোলা অবস্থায় চললে নির্ঘাত ছিটকে পড়বে রাস্তার ওপর, তাই হুড তুলে দিয়ে চাদিতে খটাং খটাং বাড়ি খেতে খেতে চলল রানা রিকশায় চেপে।
ডাকবাংলোতে সৌভাগ্যক্রমে একখানা ঘর খালি ছিল, পেয়ে গেল রানা। খোঁজ নিয়ে জানা গেল অন্যান্য ঘরগুলোতে বিশ্রাম নিচ্ছে সকালের ট্রেনে যশোর। থেকে আসা কলকাতার সাংস্কৃতিক মিশনের শিল্পীবৃন্দ।