চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন রাহাত খান। তারপর কম্পিউটারের সামনে গিয়ে কয়েকটা বোতাম টিপে দিলেন। কয়েকটা বাতি জ্বলল নিভল, ঘড়র ঘড় শব্দ হলো ওর ভেতর থেকে। আধুনিকতম বিরাটকায় কম্পিউটার প্রয়োজনীয় তথ্য টাইপ। করে দিল। কাগজটা ছিঁড়ে নিয়ে রানার হাতে দিয়ে রাহাত খান বললেন, কলকাতা থেকে এই ইনফরমেশন এসেছে।’
রানা চোখ বুলাল কাগজটার উপর। তাতে লেখা:
Something serious cooking up in Titagarh called ‘Operation Goodwill’–the present Mission is connected with it, ‘H’ leading the group.
শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেল রানার কথা কয়টা পড়ে।
ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পারছ এবার? রানা মাথাটা কাত করলে আবার শুরু করলেন রাহাত খান। ‘H’ যেখানে দলপতি হয়ে এসেছে সেখানে রহমানকে দেয়া আমারই ভুল হয়ে গিয়েছিল। বিপদের জন্য আমাদের রহমানও প্রস্তুত ছিল-কিন্তু মৃত্যুর জন্যে কে কখন প্রস্তুত থাকে? একটু কোথাও ভুল করেছে-ব্যস…
ডানহাতটা উপুড় করে রাখা ছিল টেবিলের উপর, তিন ইঞ্চি উপরে উঠিয়ে কব্জি থেকে সামনেটুকু ডান দিকে দ্রুত একবার ঝাঁকালেন রাহাত খান। অর্থাৎ-খতম।
কাজেই সাবধান। রহমানের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেব আমরা। চুপচাপ হজম করব না। কিন্তু প্রথমে ওদের উদ্দেশ্য জানা দরকার। ও হ্যাঁ, ভাল কথা। ইয়াং টাইগারস-এর নাম শুনেছ?
ইদানীং বেশ শোনা যাচ্ছে এদের নাম, স্যর। কতকগুলো বড় লোকের ছেলে।
হা। পূর্ব পাকিস্তানের সব বাঘা বাঘা শিল্পপতিরা মিলে করেছে টাইগারস ক্লাব-আর তাদের বখে যাওয়া অপদার্থ ছেলেরা মিলে ক্লাব গড়েছে ইয়াং টাইগারস। কোটিপতি বাপের টাকার জোরে মদ, জুয়া, মেয়েমানুষ নিয়ে। যথেচ্ছাচার করে বেড়াচ্ছে। ওদের কয়েকটা অপকর্মের কথা আমার কানেও এসেছে। খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি টাকার জোরে ফাইল গায়েব। এদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় কয়েকজন নানান অপকৌশলে (ঘুষ, মদ, নারী) ভাল ভাল কিছু ইণ্ডাস্ট্রি বাগিয়ে নিয়েছে ইতিমধ্যেই। যাক, যশোর থেকে খবর এসেছে কয়েকজন। ইয়াং টাইগারস এই মিশনের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে। ওদের একজন নর্তকীর উপর নাকি তাদের চোখ। এদের আণ্ডারএস্টিমেট কোরো না। প্রয়োজন হলে কঠিন। ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দ্বিধা কোরো না। আমার সমর্থন থাকবে তোমার পেছনে। এখন বলো, তোমার কোনও প্রশ্ন আছে?’
না, স্যর।
কেন জানি রানার মনে হলো কোনও কারণে রাহাত খান ভিতর ভিতর বড় উদ্বিগ্ন এবং বিরক্ত। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস হলো না। ব্যক্তিগত প্রশ্ন পছন্দ করেন না রাহাত খান। হয়তো H-এর ধৃষ্টতা এই উদ্বেগের কারণ হবে। রহমানের মৃত্যু হয়তো কুরে কুরে যন্ত্রণা দিচ্ছে ওকে।
প্যাড থেকে একটা কাগজ টান দিয়ে ছিঁড়ে চার ভাজ করে রানার দিকে বাড়িয়ে দিলেন তিনি।
‘এতে যা লেখা আছে কাল প্লেনে উঠে তারপর পড়বে। আজ সাতাশে আগস্ট-ওরা আছে যশোরে, কুষ্টিয়ায় থাকবে আটাশ-ঊনত্রিশ, রাজশাহীতে তিরিশ-একত্রিশ, দিনাজপুরে পয়লা-দোসরা। কথাগুলো মনে রেখো। আর কেবল বিপদ নয়, মৃত্যুর জন্যেও প্রস্তুত থেকো। ব্যস, আর কোনও কথা নেই, যেতে পার।’
আস্তে দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল মাসুদ রানা কামরা থেকে।
.
০৩.
২৮ আগস্ট, ১৯৬৫।
মোখলেস এসে খবর দিল ট্যাক্সি এসে গেছে। অর্থাৎ, এবার দয়া করে গাত্রোখান করুন।
‘তুই আমার সুটকেসটা তুলে দে তো গাড়ির পিছনে,’ বলল রানা।
‘দিয়েছি, স্যর।
তবে যা ভাগ এখান থেকে। চা খেয়ে নি-দাঁড়াতে বল্ ড্রাইভারকে।
রানাকে দেখেই লাফিয়ে ট্যাক্সির ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে এল ড্রাইভার। বেঁটে-খাটো হাসি-খুশি চেহারার লোকটা। ঢিলা খাকি কোর্তার বুক পকেট দুটো ফুলে আছে রুমাল, লাইসেন্স, টাকা-পয়সা, কিংস্টর্ক সিগারেটের প্যাকেট, দিয়াশলাই, চিরুনি আর হরেক রকম হাবিজাবি কাগজে। ময়লা পাজামার ততধিক ময়লা ফিতে ঝুলছে হাঁটুর কাছে। পায়ে প্রচুর ঝড়ঝাঁপটাতেও টিকে থাকা একটা থ্যাবড়া নাকের লেস-হীন জুতো। বয়স চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যে হবে। সামনের দিকে একটা দাঁত নেই–সেই ফাঁকের মধ্যে একটা খেলাল ধরা। মিলিটারি কায়দায় ঝটাং করে এক স্যালিউট লাগিয়ে দিল সে রানাকে দেখে আনন্দের আতিশয্যে। থুক’ করে মুখ থেকে খেলালটা ফেলে দিয়ে ফোকলা হাসি হাসল।
‘আরে, হুজুর, আপনে! আপনেরে বিচরাইতে বিচরাইতে তো এক্কেরে পেরেসান হোইয়া গেছি গা। পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখল সে রানাকে। ‘আমি দিলে ভাবি, মানুষটা গেল কই? এক্কেরে গায়েব হোইয়া গেল গা! ইমুন সাংগাতি পাওলানটারে হালায় এখি বস্কিং মাইরা রাবিস বানাইয়া ফালাইল! হিকমতটা কি-আরিব্বাপরে বাপ!’
রানাকে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবার বলল, আরে উইঠা পরেন, হুজুর; খামোস খায়া খারোইয়া রইলেন কেলেগা?
এমন বিচিত্র ভাব সংমিশ্রিত আকস্মিক অভ্যর্থনায় অবাক হয়ে গিয়েছিল রানা। ড্রাইভারের পাশের সিটে উঠে বসল সে। তারপরই মনে পড়ল সেই ঘটনার কথা। মাস ছয়েক আগে রাত প্রায় এগারোটার দিকে সাভার আর নয়ারহাটের মাঝামাঝি জায়গায় জঙ্গলের ধারে এর গাড়ি আটক করেছিল একদল দুবৃত্ত। রানা আসছিল মানিকগঞ্জ থেকে। দূর থেকেই ব্যাপারটা আঁচ করে হেড লাইট অফ করে গিয়ার নিউট্রাল করে নিঃশব্দে একেবারে কাছাকাছি এসে থেমেছিল রানা। প্রাণভয়ে থর থর করে কাঁপছিল আর ভেউ ভেউ করে কাঁদছিল ড্রাইভার। ছোরা মারার ঠিক আগের মুহূর্তে যমদূতের মত এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রানা সর্দারের। উপর। বেশ মারপিটও হয়েছিল। বেগতিক দেখে পালিয়েছিল দুবৃত্তরা। প্রাণ রক্ষা। পেয়েছিল (কী যেন নাম বলেছিল…ও, হ্যাঁ) ইদু মিঞার। সেই কৃতজ্ঞতা এই খাস। ঢাকাইয়া কুট্টির মনে যে এমন উজ্জ্বল হয়ে থাকবে ভাবতেও পারেনি রানা।