রানার ছেলেমানুষি রাগ দেখে এবার উচ্চ কণ্ঠে হেসে উঠল রেহানা। তীব্র দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত তার প্রতি কপট অগ্নি বর্ষণ করে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল রানা ঘর থেকে।’
.
সাততলার উপর গোলাম সারওয়ারের কামরার মধ্যে দিয়ে গিয়ে মেজর জেনারেল রাহাত খানের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল রানা। হাতলে হাত দিয়ে, বরাবর যেমন হয়, হঠাৎ বুকের মধ্যে ছলাৎ করে উঠল এক ঝলক রক্ত। অন্যমনস্ক ভাবে গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ সামনে লোক পড়ে গেলে যেমন হয় তেমনি। ছুরির ফলার মত শান দেয়া ছিপছিপে লম্বা এই বুদ্ধিমান লোকটির তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে। গিয়ে দাঁড়াতে হবে ভাবলেই কেন জানি রানার বুকের ভিতরটা হিম হয়ে আসে। এই বৃদ্ধকে ও কতখানি ভালবাসে, কতু ভক্তি করে তা ও জানে; কিন্তু এত ভয় যে কেন করে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।
মস্ত এয়ারকণ্ডিশণ্ড রুমে একটা দামি সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওধারে পিঠ উঁচু রিভলভিং চেয়ারে সোজা হয়ে বসে একটা প্যাডের উপর খস খস করে কী যেন লিখছেন রাহাত খান। চোখ না তুলেই বললেন, বসো।’
একটা চেয়ারে বসে ঘরের চারধারে চেয়ে দেখল রানা। মাস চারেক আগে যেমন দেখেছিল, প্রায় তেমনি ছিমছাম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আছে ঘরটা। বদলের মধ্যে এই, টেবিলের উপর কিং সাইজ চেস্টারফিল্ডের বদলে এক বাক্স কিউবার তৈরি হাভানা চুরুট। সপ্রতিভ অভিজাত চেহারায় এতটুকু পরিবর্তন নেই। তেমনি ধবধবে সাদা ঈজিপশিয়ান কটনের স্টিফ কলার শার্ট, সার্জের সুট আর বৃটিশ কায়দায় বাঁধা দামি টাই।
হংকং-এর ব্ল্যাক হক অ্যাসাইনমেন্ট-এ আমাদের সাফল্যে চাইনিজ গভর্নমেন্ট এতই সন্তুষ্ট হয়েছে যে পিসিআইকে গ্রাচুলেট করে বার্তা পাঠিয়েছে একটা। কিন্তু আমার ধারণা অতখানি রিস্ক নেয়া তোমার উচিত হয়নি। ডক্টর হকের পুরো রিপোর্ট আমি পড়ে দেখেছি। ছোরাটা আর এক ইঞ্চি বাম দিকে লাগলেই তোমার দুঃসাহসের ইতি হয়ে যেত। যাক, এখন বিষের ক্রিয়া আর নেই। এফ-সেকশন তোমাকে সম্পূর্ণ সুস্থ বলে সাটিফাই করছে।
রানা কোনও কথা বলল না। বুঝল, এই কথাগুলোর মানে, এবার নতুন কাজের ভার নিতে হবে তোমাকে, প্রস্তুত হয়ে নাও। বাক্স থেকে একখানা সেলোফেন পেপার মোড়া সিগার বের করে সযত্নে কাগজ ছাড়িয়ে ধরিয়ে নিলেন। রাহাত খান রানার উপহার দেয়া রনসন ভ্যারাফ্লেম গ্যাস লাইটার জ্বেলে। দামি তামাক পাতার কড়া গন্ধ এল নাকে।
‘U সেকশনের ওই ফাইলটা পড়েছ? কী লিখেছে ওতে?
‘পড়েছি, স্যর। সাংস্কৃতিক মিশন এসেছে কলকাতা থেকে গত বাইশ তারিখে। নাচ-গান-বাজনার জন্য জনা পনেরো শিল্পী আর দশ বারোজন টেকনিশিয়ান এসেছে স্টেজ ডেকোরেশন, মাইক এবং লাইট কন্ট্রোলের জন্য। নামগুলো মনে নেই, স্যর। পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করে বেড়াচ্ছে ওরা।’
ব্যস! এই? আর কিছু চোখে পড়েনি তোমার?
আর একটা ব্যাপারে একটু খটকা লেগেছে, স্যর। ঢাকার পরেই চট্টগ্রাম যাওয়া উচিত ছিল ওদের। তা না গিয়ে ওরা গেছে খুলনায়। তারপর যশোর। ওদের প্রোগ্রাম দেখছিঃ খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী এবং দিনাজপুর। অর্থাৎ আগাগোড়া পূর্ব পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্ত বা পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব সীমান্ত ঘেঁষে। রাহাত খানের মুখের দিকে চেয়ে রানা দেখল একটা প্রশংসাসূচক সূক্ষ্ম হাসির রেখা। রানা তার দিকে চাইতেই মিলিয়ে গেল হাসিটা।
‘বেশ। এখন বলো দেখি অল ইণ্ডিয়া রেডিয়ো যখন দৈনিক চার-পাঁচ ঘণ্টা চিৎকার করে পৃথিবীর কাছে নালিশ জানাচ্ছে আমরা কাশ্মীরে ইনফিলট্রেটর ঢুকিয়েছি, ছত্রী সেনা এবং স্যাবোটিয়ার পাঠিয়েছি শ্রীনগরে, কাশ্মীরে মুক্তি সংগ্রামীরা আসলে পাকিস্তানী সৈন্য ইত্যাদি, ইত্যাদি; ঠিক সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে সাংস্কৃতিক শুভেচ্ছা মিশন পাঠাবার পেছনে কী মহৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে? নিশ্চয়ই এদের কোনও বিশেষ মতলব বা স্বার্থ লুকানো আছে এর পেছনে, তাই না?’ পায়ের উপর পা তুলে একটু আরাম করে বসলেন রাহাত খান।
অসম্ভব নয়, উত্তর দিল রানা। কী সেই স্বার্থ, তাই বের করতে হবে তোমাকে।
‘আমাকে?
‘হ্যাঁ। এ কাজের ভার ছিল আমাদের খুলনা এজেন্ট রহমানের ওপর। সে এদের সাথে আঠার মত লেগে গিয়েছিল। হয়তো কিছুদূর অগ্রসর হয়েছিল। কিন্তু ঘণ্টা দুয়েক আগে খবর এসেছে তাকে কেউ নির্মম ভাবে খুন করেছে। যশোর এয়ারপোর্টের কাছে একটা ঝোঁপের ধারে তার রক্তাক্ত মৃতদেহ পাওয়া গেছে।
‘আমাদের রহমান! অবাক হয়ে গেল রানা। রহমানের প্রাণবন্ত ও বুদ্ধিদীপ্ত চেহারাটা ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। কিন্তু আমাদের দেশে আমাদের লোক মেরে রেখে যাবে এ কেমন কথা!
রানার চোখে সংকল্প দেখতে পেলেন, রাহাত খান। কয়েক সেকেণ্ড সময় দিলেন ওকে সামলে নেয়ার জন্য। নিভে যাওয়া চুরুটটা ধরিয়ে নিলেন। তারপর আবার আরম্ভ করলেন, কাল দশটার ফ্লাইটে তুমি যাচ্ছ ঈশ্বরদি। টিকেট বুক করা। হয়ে গেছে। ওখান থেকে ট্রেনে যাবে কুষ্টিয়ায়। তোমার নাম তরিকুল ইসলাম, এপিপি-র ভ্রাম্যমাণ ফটোগ্রাফার। আইডেন্টিটি কার্ড এবং অন্যান্য টুকিটাকি কয়েকটা জিনিস সকালে তোমার বাসায় পৌঁছে যাবে।
‘ঠিক কী ধরনের কাজ হবে আমার, স্যর?’
‘ওদের গতিবিধির উপর নজর রাখবে। সোহেলকে পাবে ডাকবাংলোর বয় বেয়ারাদের মধ্যে। ও তোমাকে অনেক সাহায্য করতে পারবে। আমার যতদূর। বিশ্বাস, একটা ভয়ানক প্ল্যান এঁটেছে ওরা এবার। আট-ঘাট বেঁধে নেমেছে ওরা। আমার অনুমান যদি সত্যি হয় তবে কত সাঙ্ঘাতিক আঘাত আসছে আমাদের দেশের উপর তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। ডিফেন্স সেক্রেটারি তো আমার অনুমান শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন। বেয়ারাকে ডেকে ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি খাওয়াতে বললেন, আমাকে।’ বিরক্তিতে কাঁচা-পাকা, ভুরু জোড়া কুঁচকে গেল। রাহাত খানের। কিন্তু তুমি তো আমাকে চেনো, রানা। আচ্ছা, আরেকটা জিনিস দেখাচ্ছি তোমাকে।