হঠাৎ একটা সাইলেন্সর পাইপ ভাঙা বেবি ট্যাক্সি এমন বেয়াড়া শব্দ করে সামনের রাস্তা দিয়ে চলে গেল যে রানার বিরক্ত দৃষ্টি এইসব সুন্দর দৃশ্য ছেড়ে ফিরে এল কালো পিচ ঢালা ভেজা রাস্তাটার উপর। সাইড লাইট জ্বেলে মৃদু গুঞ্জন তুলে হরেক রঙের সুন্দর সুন্দর স্যালুন, সেডান চলে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে ছবির মত। অপেক্ষা করছে রানা।
‘এক কাপ কফি দেব?’ ঠিক কানের পাশে মোলায়েম নারী কণ্ঠের এই প্রশ্নে চমকে উঠল রানা। দেখল নব-নিযুক্ত সুন্দরী স্টেনো-টাইপিস্ট মিস নাসরীন রেহানা তার একান্ত কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। রানার কাজের সুবিধার জন্যে ওকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেয়া হয়েছে হপ্তাখানেক হলো। চোখে চোখ রেখে রানা বুঝল মেয়েটি নীরবে বলছে, আশপাশে কেউ নেই, ইচ্ছে করলেই সুযোগ গ্রহণ করতে পারো, আমি আপত্তি করব না।’
কী বলছ?’ ইঙ্গিত না, বোঝার ভান করল রানা।
কফি? রেহানার চোখে স্পষ্ট আমন্ত্রণ। ঠোঁটে বাঁকা হাসি। লিপস্টিকে লাল ঠোঁট দুটোর ফাঁক দিয়ে চকচকে সাদা দাঁত দেখা যাচ্ছে অল্প একটু। আর একটু কাছে সরে এল সে। ভ্যাসলিনের গন্ধ ওর চুলে, মুখে পুরু প্রসাধনের প্রলেপ। ওড়নাটা একপাশে সরে যাওয়াতে গভীর খাদ দেখা যাচ্ছে বুকের মাঝামাঝি।
মনে মনে বিরক্ত হয়ে আবার জানালার বাইরে চোখ ফেরাল রানা। এরা তাকে কী মনে করে? তাদের ইঙ্গিত প্রত্যাশায় উন্মুখভাবে অপেক্ষমাণ বানর বিশেষ? ইশারা পেলেই ধন্য হয়ে গিয়ে নাচতে আরম্ভ করে দেবে? নারীসঙ্গ কামনা ছাড়া পুরুষের অন্য ভাবনা থাকতে পারে না আর?
‘বাতিটা জ্বেলে দাও রেহানা। আর হ্যাঁ, কফি এক কাপ দিতে পারো। তার আগে এক দৌড়ে U সেকশন থেকে একটা ফাইল নিয়ে এসো। ফোনে পারটিকুলাস দিয়ে দিয়েছি, মিসেস চৌধুরীর কাছে চাইলেই পাবে। কুইক।’
‘রাইট, স্যর, আহত আত্মাভিমান প্রকাশ পেল মেয়েটির কণ্ঠস্বরে। লাইট জ্বেলে দিয়ে মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেল সে ঘর থেকে।
মেয়েটিকে এমন বিশ্রী ভাবে প্রত্যাখ্যান করে দুঃখ হলো রানার। কী করবে বেচারি। পুরুষ বস-কে সন্তুষ্ট রাখবার একটা পথই জানা আছে তার। পৃথিবীর সবাইকে যেমন দেখেছে, রানাকেও ঠিক তেমনি মনে করে একই উপায়ে খুশি। করতে চেয়েছিল। ভাল মাইনের লোভনীয় চাকরিটার নিরাপত্তা নির্ভর করে রানার ব্যক্তিগত সন্তুষ্টির উপর-এটা বুঝে নিয়ে ঋণী করে রাখতে চেয়েছিল ওকে।
রানা কিছু ভালমানুষ নয়, অনেক দোষত্রুটি আছে ওর চরিত্রে। কিন্তু ও জয় করে নিতেই অভ্যস্ত-চাকরি ভয়ে ভীতা একটি মেয়েকে বাগে পেয়ে সুযোগ গ্রহণ। করতে নয়।
ফাইলটা দেখেই চমকে উঠল রানা। তা হলে এই ব্যাপার। আবার সেই ইণ্ডিয়া? অল্প কিছুক্ষণ আগে মেজর জেনারেল রাহাত খানের আদেশ এসেছিল ইন্টারকমে: রানা, U সেকশন থেকে IE/VII/65 ফাইলটা আনিয়ে পড়ে ফেল। লিখে নাওঃ IF/VII/65 আমি একটু ডিফেন্স সেক্রেটারির অফিসে যাচ্ছি। অল্পক্ষণেই ফিরব। তুমি অফিসেই থেকো-কথা আছে।
তখনই বুঝেছিল রানা, বুড়োর মাথায় কোনও নতুন পোকা ঢুকেছে। ফাইলটা। দেখেই বুঝতে পারল আর একটা অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি হচ্ছে ওর জন্য। আবার শক্তি পরীক্ষায় নামতে হবে ওকে কোনও বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে। খুশি হয়ে উঠল রানার মন।
ফাইলের পাতায় ডুবে গিয়েছিল মাসুদ রানা। একটা সিগারেট ঠোঁটে লাগিয়ে সেটা ধরিয়ে নিতেও ভুলে গিয়েছিল। শেষ পাতাটা উল্টাতেই হঠাৎ খট করে একটা শব্দে চমকে উঠল রানা। দেখল ওর রনসন লাইটারের ছোট্ট চোয়ালটা হাঁ হয়ে আছে। রেহানার হাতে ধরা সেটা।
সিগারেট ধরিয়ে রানা বলল, ‘থ্যাঙ্কিউ।’
‘ইউ আর ওয়েলকাম, স্যর। আপনার কফি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
ফাইলটা বন্ধ করে কফির কাপে চুমুক দিল রানা। তারপর সপ্রশংস দৃষ্টিতে রেহানার দিকে চেয়ে বলল, ‘অপূর্ব হয়েছে তো কফিটা! বানিয়েছে কে?
‘আমি।’
‘চমৎকার! কিন্তু তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে, রেহানা। ওই। বুড়োকে (ছাতের দিকে চোখের ইঙ্গিত করল রানা) কোনওদিন কফি খাওয়াতে পারবে না।’
‘কেন? সত্যিই বিস্মিত হলো রেহানা। ওঁকে কফি খাওয়ালে কী হবে?
‘এক কাপ কফি খেলেই বুড়ো তোমাকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে নিজের স্টেনো করে নেবে। আর ওই গোলাম সারওয়ার ভূতটা এসে পড়বে আমার ঘাড়ে।
তা হলে ভালই হবে,’ হেসে ফেলল রেহানা। সহজ হতে পেরে বেঁচে গেল ও।
ঠিক এমনি সময়ে ইন্টারকমের মধ্য থেকে একটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর যেন চাবুক মারল রানাকে।
‘ওপরে এসো, রানা। আর এইসব হালকা আলাপ করবার সময় ইন্টারকমের সুইচটা অফ করে দিয়ো।’
জিভ কাটল রেহানা চোখ বড় বড় করে।
‘সরি, স্যর, এক্ষুণি আসছি, স্যর,’ বলেই অফ করে দিল রানা ইন্টারকমের সুইচ। যেন চুরি করে ধরা পড়েছে এমনি মুখের ভাব হলো।
নিজের টাইপ রাইটারের সামনে ফিরে গিয়ে মুখটা হাঁ করে নিঃশব্দে হাসছে। রেহানা রানার এই পর্যুদস্ত অবস্থায় আন্তরিক খুশি হয়ে। জোরে হাসতে সাহস হচ্ছিল না, পাছে রাহাত খান শুনে ফেলে। পিত্তি জ্বলে গেল রানার তাই দেখে।
ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ও রেহানার ডেস্কের সামনে। তারপর ধাই করে প্রচণ্ড এক কিল বসাল ডেস্কের উপর। আধ হাত লাফিয়ে উঠল টাইপ রাইটার।
হাসছ কেন? ফাজিল মেয়ে কোথাকার! এত হাসির কী আছে?’