মিত্রার মুখে নিজের নাম শুনে অবাক হলো না রানা। মনে মনে ভাবল, আমাকে হত্যা করা হলে তোমার কী ক্ষতি, সুন্দরী। মুখে বলল, ‘কেন? আমার অপরাধ?
‘দলপতির বিশ্বাস আপনি আমাদের বিরুদ্ধে এমন কিছু তথ্য জানতে পেরেছেন যা আমাদের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। কাজেই আর কোনও পথ নেই; সরিয়ে দিতে হবে আপনাকে এই পৃথিবী থেকে। আর আপনাকে এই নিশ্চিত মৃত্যুর ফাঁদে ফেলবার জন্যে আমাকে ওরা ব্যবহার করছে টোপ হিসেবে। খুব। দ্রুত কথাগুলো বলে গেল মিত্রা। ওর চোখে-মুখে স্পষ্ট উদ্বেগ ও উত্তেজনা।
‘চক্রান্ত, ফাঁদ, মৃত্যু, এইসব কথা শুনে মন খারাপ করছে, কিন্তু টোপটা আমার ভারি পছন্দ হয়েছে। আমি এই টোপ গিলতে রাজি আছি। যা থাকে কপালে! হাসল রানা।
আপনি হাসছেন? উহ, এর গুরুতু যদি আপনাকে বোঝাতে পারতাম!’ তর্জনী ভাজ করে কামড়ে ধরল অসহিষ্ণু মিত্রা সেন। ওই যে ওরা সব এসে পড়েছে।
বাইরে কয়েকটা পায়ের শব্দ শোনা গেল। এগিয়ে আসছে কারা কাঠের মেঝের উপর মচমচ শব্দ তুলে। আর সময় নেই। রানা চেয়ে দেখল উত্তেজনা, ভয় আর হতাশায় রক্তশূন্য হয়ে গেছে মিত্রার মুখ। বুঝল এটা অভিনয় হতে পারে না।
হঠাৎ রানার বাঁ হাতটা তুলে নিল মিত্রা তার হাতে। চাপা গলায় বলল, ‘আমাকেও জড়িয়েছে ওরা। এই নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্র যদি সফল হয় তবে আত্মহত্যা ছাড়া আর পথ নেই আমার। আমি বাঁচতে চাই, মি. রানা! এই বিদেশে আপন কেউ নেই আমার। মৈত্র মশাই নিজেই এই চক্রান্তের উদ্যোক্তা। আমাকে ভাসিয়ে দিচ্ছে এরা বানের জলে। রক্ষা করবে আমাকে, রানা? তোমার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইছি আমি। বলো, বাঁচাবে আমাকে?
আকুল মিনতি মিত্রার চোখে। রানা বুঝল, ও এমন একটা ফাঁদে পা দিতে যাচ্ছে যেখান থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন হবে। স্থির দৃষ্টিতে মিত্রার চোখের দিকে চেয়ে ও বুঝল এই কাতর মিনতি অবহেলা করবার সাধ্য ওর নেই। কিন্তু কী সেই চক্রান্ত যাকে মিত্রার এত ভয়? লোকগুলো দরজার কাছে এসে গেছে। আর সময়। নেই সব কথা শুনবার।
‘চেষ্টা করব,’ বলল রানা।
মিত্রার কাছে এই আশ্বাসটুকুর অনেক দাম। কৃতজ্ঞতায় দু’ফোঁটা জল বেরিয়ে এল ওর চোখ থেকে। রানার বাঁ হাতের উল্টোপিঠে আলতো করে চুম্বন করল সে, তারপর নরম গালের উপর একবার চেপে ধরেই ছেড়ে দিল। খানিকটা চোখের জল লেগে গেল রানার হাতে।
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শোনা গেল।
‘নিজেকে বড় স্বার্থপর বলে মনে হচ্ছে। নিজেকে বিপদমুক্ত করার জন্যে জেনে শুনে তোমাকে মৃত্যু-ফাঁদে পা দিতে অনুরোধ করছি। কিন্তু আমি বড় অসহায়। তুমি জানো না কত ভয়ঙ্কর লোক ওরা।’ শিউরে উঠল মিত্রা। আরেকটা শেষ কথা: যদি দ্বিধা হয়, যদি মৃত্যুর ঝুঁকি এড়িয়ে যেতে ইচ্ছে করে, তবে বাঁচার পথও বলে দিচ্ছি-আজ রাতে কিছুতেই ঘর থেকে বেরিয়ো না। কোনও অবস্থাতেই না। আমার যা হবার হোক…’।
মিত্রার খসখসে কণ্ঠস্বর ছাপিয়ে প্রবল বেগে আবার কড়া নাড়ার শব্দ হলো।
তুমি লুকিয়ে পড়ো কোথাও। না।’
গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিয়ে রানা দেয়ালে বসানো চার বাই তিন ফুট আলমারিটার ছোট্ট তালা এক ঝটকায় ভেঙে ফেলল।, যা ভেবেছিল, ঠিক তাই। ডালাটা খুলতেই দেখা গেল একখানা জাপানী ট্রানজিস্টার টেপ-রেকর্ডার নিশ্চিন্ত। মনে ঘুরছে ভিতরে বসে। ওদের কথাবার্তা সব রেকর্ড হয়ে গেছে।
ক্ষুদ্রাকৃতি স্কুল দুটো তুলে নিল রানা টেপ-রেকর্ডার থেকে। তারপর গ্রিনরুমের পেছনের খোলা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল পানা ভর্তি পুকুরে।
তুমি জানতে? আলমারির ডালাটা বন্ধ করে জিজ্ঞেস করল রানা।
না।’
এবার প্রবল এক ধাক্কায় ছিটকিনি ভেঙে দু’ফাঁক হয়ে খুলে গেল দরজা। হুড়মুড় করে ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়াল জয়দ্রথ মৈত্র। পিছনে আরও কয়েকজন লোক।
হলুদ দৃষ্টি মেলে দুজনকে দেখল জয়দ্রথ মৈত্র। তারপর বলল, সরি ফর দ্য। ইন্টারাপশন। পরিষ্কার বিরক্তির ভাব প্রকাশ পেল তার কণ্ঠে।
‘দ্যাটস অল রাইট, উত্তর দিল রানা। তারপর দৃঢ় পদক্ষেপে মৈত্রকে পাশ কাটিয়ে চেয়ার থেকে গ্যাজেট ব্যাগ আর ফ্ল্যাশ-গানটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। যেতে যেতে মিত্রার কৈফিয়ত কানে গেল তার।
‘উনি একটা ক্লোজ-আপ ছবি নিতে…’
দরজা বন্ধ করে নিয়েছিল কেন?’
‘আমি, মানে, উনি…
মৃদু হেসে রাস্তায় গিয়ে পড়ল মাসুদ রানা।
.
০২.
২৭ আগস্ট, ১৯৬৫।
মতিঝিল কমার্শিয়াল এরিয়ায় ছয়তলার উপর একটা কার্পেট বিছানো ঘরের পশ্চিমমুখী জানালাটা খোলা। পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এজেন্ট মাসুদ রানা সে-জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আনমনে স্টেডিয়ামের সবুজ ঘাসের দিকে চেয়ে রয়েছে। অসম্ভব বৃষ্টি হওয়ায় মাঠে পানি জমে আজ বিকেলের ফুটবল খেলা বাতিল হয়ে গেছে। পতাকা নামিয়ে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বেশ কিছুক্ষণ হয় বৃষ্টি থেমেছে। পশ্চিম আকাশের সাদা মেঘের গায়ে এখন নানা রঙের খেলা। সারি সারি দর্শকদের গ্যালারি একেবারে ফাঁকা। দুটো ছাগল, বোধহয় দারোয়ানের হবে, নিশ্চিন্ত মনে চরছে মাঠে। পাশে সুইমিং পুলের টলটলে পরিষ্কার জলে আঁটসাঁট কস্টিউম পরে সাঁতার প্র্যাকটিস করছে কয়েকটা উন্নতস্তনা, অ্যাংলো। তরুণী। বায়তুল মোকাররমের গম্বুজের উপর চোখ পড়ল এবার রানার। তারপর সিঁড়িতে। কয়েকজন মুসল্লি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে মগরেবের আজান শুনে। প্রকাণ্ড জিপিও বিল্ডিংটা গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য ডেড লেটার-এর বোঝা বুকে নিয়ে। আরও অনেক দূরে রেস কোর্সের শিব মন্দিরের চুড়ো দেখা যাচ্ছে। আবছা। ঢাকা নগরীর বুকে সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে।