পকেটে হাত দিয়ে একটা ছোট্ট কাগজ পেল রানা। ভাবল, বার্তা হবে কিছু।
চারকোণা ছোট কাগজের উপর ইংরেজিতে টাইপ করা:
BEWARE GENTLEMAN, DANGER AHEAD!
প্রথমেই রানা ভাবল, টাইপ করা যখন, এটা তাকে দেবে বলে কেউ আগে। থেকেই মনস্থ করে এসেছে, হঠাৎ করে তার মাথায় আসেনি এই সাবধান বাণী-অর্থাৎ, পূর্ব পরিকিল্পিত। কিন্তু কে তাকে সাবধান করতে চায়, শত্ৰু না মিত্র? এবং কেন? কীসের বিপদ সামনে? ঘাই হরিণীর মত কি মিত্রা ডাকছে তাকে মৃত্যুর পথে? নাকি কেউ ভয় দেখিয়ে দূরে সরাতে চাইছে ওকে?
দুই হাত মাথার উপর তুলে চিঠিটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ল রানা-যেন ওর উপরে যে বা যারা লক্ষ্য রাখছে, তারা স্পষ্ট দেখতে পায় ওর কার্যকলাপ। তারপর উপর দিকে টুকরোগুলো ছুঁড়ে ফুঁ দিয়ে ছিটিয়ে দিল চারদিকে। আশপাশে সবার মাথায় ঝরে পড়ল সেগুলো পুঘৃষ্টির মত।
ছোট দরজা দিয়ে বেরিয়ে স্টেজের পিছন দিকে চলে এল রানা। গেটের কাছে দাঁড়ানো নীল ব্যাজ বুকে আঁটা ভলান্টিয়ার রানাকে দেখে পথ ছেড়ে দিল। ভিতরে ঢুকে এদিক-ওদিক চাইতেই একটা ছোট ঘরের আধ-ভেজানো দরজা দিয়ে মিত্রা সেনকে দেখতে পেল রানা। দ্রুত কাপড় ছাড়ছে সে। স্টেজের পিছনে। অনাদর অবহেলায় পড়ে থাকা গোটা কতক ক্যানভাসের উইং, এলোমেলো করে ফেলে রাখা কয়েকটা বাঁশ আর কিছু নারকেলের রশি টপকে ড্রেসিংরুমের সামনে। গিয়ে দাঁড়াল রানা।
‘ভেতরে আসুন! মিত্রার চাপা কণ্ঠস্বর।
ঢুকতে গিয়ে আবার পিছিয়ে এল রানা। মিত্রার পরনে ব্রেসিয়ার এবং পেটিকোট ছাড়া কিছু নেই। এতক্ষণ একটানা নাচের পর হাঁপাচ্ছে সে। সেই সঙ্গে ওঠা-নামা করছে বুকের সঙ্গে ঘামে সেঁটে থাকা একখানা দামি লকেট। সারা শরীরে স্বেদ বিন্দু। নাচের ঝলমলে পোশাক-পরিচ্ছদ খুলে একটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা। আয়না-ভাঙা ড্রেসিং টেবিলটা ষোড়শ শতাব্দী মডেলের।
রানা ভাবল: থারটি-সিক্স-টোয়েন্টি-টু-থারটি-সিক্স! আইডিয়াল!
চঞ্চল হয়ে ওঠা মনটাকে সংযত করল রানা।
কই, দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে আসুন।
এবার রানার টনক নড়ল। সেটির চাপা খসখসে অথচ তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরে ধৈর্যচ্যুতির আভাস পাওয়া গেল। এ যেন অনুরোধ নয়, আদেশ। ঢুকে পড়ল রানা ঘরের ভিতর।
‘ছিটকিনি লাগিয়ে দিন দরজার। লজ্জা করার সময় এটা নয়। জরুরি কথা আছে। দোহাই আপনার, বোকার মত দাঁড়িয়ে না থেকে তাড়াতাড়ি করুন-সময় নেই মোটেও। এক্ষুণি ওরা সব এসে পড়বে।’
মেয়েটির কণ্ঠস্বরে এমন একটা উত্তেজিত জরুরি ভাব প্রকাশ পেল যে প্রায় চমকে উঠল মাসুদ রানা। সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল তার। অদ্ভুত কিছু শুনবার জন্য মনটাকে প্রস্তুত করে নিল ও একমুহূর্তে।
নড়বড়ে বল্টুটা লাগানো না লাগানো সমান কথা। তবু সেটা লাগিয়ে দিয়ে। ঘুরে দাঁড়াল রানা। স্থির দৃষ্টিতে আপাদমস্তক একবার দেখল মিত্রাকে। ভাবল, হঠাৎ আজ এই মুহূর্তে নিজের দলটা ‘ওরা’ হয়ে গেল কেন এই মেয়েটির কাছে? কুষ্টিয়ার অনুষ্ঠানে তার প্রতি স্পষ্ট ঘৃণা দেখতে পেয়েছে রানা মিত্রার চোখে। আজ সে-ই আপন লোক হয়ে গেল, অন্যেরা পর-কেমন করে হয়! এর মধ্যে গোলমাল আছে কিছু। সাধু, সাবধান!
রানার স্থির দৃষ্টির সামনে এবার একটু লজ্জা পেল মিত্রা সেন।
চট করে ঘুরে ব্লাউজ টেনে নিয়ে একটা হাত ঢুকিয়ে দিল। মুখে বলল, ‘আপনাকে এখানে ঢুকতে দেখেছে কেউ?
‘বোধহয় না,’ উত্তর দিল রানা নিরাসক্ত কণ্ঠে।
কুঁচি দেয়া পেটিকোটে ঢাকা একখানা চমৎকার সুডৌল নিতম্বের উপর চোখ। পড়ল রানার মিত্রা ঘুরে দাঁড়াতেই। এঁটে বাঁধা ব্রেসিয়ারের ফিতেগুলো পিঠের নরম-মাংসের উপর চেপে বসে আছে।
মৃদু হেসে এগিয়ে গিয়ে গ্যাজেট ব্যাগ আর ফ্ল্যাশ গানটা নামিয়ে রাখল রানা একটা চেয়ারের উপর। বলল, কুষ্টিয়ার সেই গুণ্ডাদের নিন্দে করে লাভ কী, দোষ তো তাদের নয়, দোষ আপনার। আমার মাথাটাও আজ খারাপ হয়ে যাবার জোগাড় হয়েছে, মিস মিত্রা। পৃথিবীর সব রূপ…’
‘চুপ করুন, আমার সঙ্গে ফ্লার্ট করবার জন্যে আপনাকে ডাকিনি। আপনার, আমার দুজনের সামনেই ভয়ানক বিপদ এখন।
মিত্রাকে শাড়ি পরে নেবার সুযোগ দিয়ে গ্রিনরুমের পিছন দিকের খোলা জানালাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রানা। ঠাণ্ডা এক ঝলক মুক্ত বাতাস এল জানালা দিয়ে। বুক ভরে শ্বাস গ্রহণ করল সে। তারপর চামড়া মোড়া দামি সিগারেট কেস থেকে একটা সিনিয়র সার্ভিস বের করে অগ্নি সংযোগ করল। বাইরে প্রায় জানালার সঙ্গে লাগানো একটা কচুরিপানা ভর্তি পুকুর। কানায় কানায় টই টম্বুর। মোলায়েম জ্যোৎস্নায় পুকুর পাড়ের নারকেল গাছ দুটোকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। দেখতে। রানা ভাবল, সুন্দর’ আর ‘বিপদ’ এই দুটো জিনিসে কোথায় যেন একটা যোগসূত্র আছে। পৃথিবীর বেশির ভাগ জিনিস যা সুন্দর, রানা দেখেছে তার। আশপাশেই ওত পেতে থাকে বিপদ। মিত্রার চারপাশে বিপদ ঘনিয়ে আসবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
পাশে এসে দাঁড়াল মিত্রা।
‘একটা ভয়ঙ্কর চক্রান্তের জাল পাতা হয়েছে আপনার জন্যে, মি. …’
‘আমি নগণ্য এক ফটোগ্রাফার-তরিকুল ইসলাম। আমাকে আপনি এসব কী ভয়ঙ্কর কথা শোনাচ্ছেন?’-সত্যি সত্যিই বিস্মিত হবার ভান করল রানা।
বাজে কথায় সময় নষ্ট করবেন না, মি. মাসুদ রানা। মিত্রার কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট তিরস্কার। সেই প্রথম দিন থেকেই আমি কেন, সাংস্কৃতিক মিশনের প্রত্যেকটি লোকই জানে আপনার আসল নাম, আসল পরিচয়। হাতে সময় নেই, এক্ষুণি ওরা এসে পড়বে, দয়া করে আমার কথাগুলো বলতে দিন। কপাল থেকে একগুচ্ছ অবাধ্য চুল নিয়ে গুঁজে দিল মিত্রা কানের পাশে। তারপর আবার বলল, আজ রাতে আপনাকে হত্যা করা হবে, মি. রানা!’