ধিক তেই ধিগি তেই/ধিক তেই ধিগি তেই/ধিগি ধিগি থেই/
ধিগি ধিগি ধিক থেই/ধিগি ধিগি থেই/তা থেই তা থেই/
থেই তা থা/ থেই তা থা/থেই তা/ধিক তেই ধিগি তেই/
ধিক তেই ধিগি তেই/ধিগি ধিগি থেই/ধিগি ধিগি ধিক থেই/
ধিগি ধিগি থেই/তা থেই তা থেই/থেই তা থা/থেই তা থা/
থেই তা/
ধা ধিন ধিন ধা/ধা ধিন ধিন ধা/না তিন তিন না/
তেটে ধিন ধিন ধা…
এবার এগিয়ে গেল রানা দর্শকদের বিরক্তি উৎপাদন করে স্টেজের মাঝ বরাবর। তারপর হঠাৎ ঘুরে, যেন দর্শকদের ছবি তুলছে এমনি ভাবে সেই ছোট্ট দলটির ছবি তুলে নিল। অপ্রস্তুত দলটি ফ্ল্যাশ লাইটের হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে। প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তারপর জয়দ্রথ ছাড়া বাকি সবার হাত দ্রুত উঠে এসে নিজ নিজ চেহারা আড়াল করার চেষ্টা করল। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। মৃদু হাসল রানা।
এক, দুই করে নয় সেকেণ্ড পার হলো। জ্বলে উঠল ফ্ল্যাশ গানের পিছনে লাল বাতি। রি-চার্জিং সাইকল কমপ্লিট হয়েছে। এবার আরও কয়েকটি ছবি তুলল ও মিত্রা সেনের বিশেষ বিশেষ নৃত্য ভঙ্গিমার, বিভিন্ন দূরত্ব থেকে বিভিন্ন অ্যাপারচার। দিয়ে। মাথার মধ্যে দ্রুত চিন্তী চলছে রানার। ঢাকার কুখ্যাত ইয়াং টাইগারস পিছু ছাড়েনি তা হলে! কিন্তু এদের সঙ্গে কলকাতার সাংস্কৃতিক মিশনের দলপতির এই দহরম-মহরম কেন? কুষ্টিয়ায় মিত্রা সেনকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল যারা, যাদের হাত থেকে রানা রক্ষা করেছিল মিত্রাকে কিন্তু প্রতিদানে পেয়েছিল কুৎসিত ব্যবহার, সব জেনে শুনেও তাদের সঙ্গে জয়দ্রথ মৈত্রের এই মৈত্রী কীসের? ঈশ্বরদি জংশনের রিফ্রেশমেন্ট রুমেই প্রথম রানার চোখে পড়ে এদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে নিয়েছে জয়দ্রথ মৈত্র। কী মতলব আঁটছে সে এদের সঙ্গে? রাজশাহীতে পৌঁছে ডাকবাংলোতে মিত্রা সেনের ব্যবহারই বা এমন হঠাৎ পাল্টে গেল কেন? ঠিক তার পাশের ঘরটা বুক করল মিত্রা-দলপতি তাতে আপত্তি করল না। ট্রেনে তা হলে গুলিবর্ষণ করল কে? তা ছাড়া আজ সারাদিন মনে হচ্ছিল মিত্রা যেন কিছু বলতে চায় তাকে, কিন্তু বলি বলি করেও সুযোগ করে উঠতে পারছে না। কী সে কথা? নিশ্চয়ই কোনও ট্র্যাপ পেতেছে ওরা। সামনে। বিপদের গন্ধ পেল রানা।
হঠাৎ রানার মনে হলো মিত্রা যেন তার দিকে চেয়ে আবছা একটা ইঙ্গিত করল। আশ্চর্য হয়ে গেল রানা। শেষবারের মত ক্লিক করে শাটার টিপে দিল সে। এক ঝলক তীব্র আলো ছুটে গিয়ে আলিঙ্গন করল মিত্রা সেনকে। শাটারের উপর আঙুলের চাপ পড়তেই এক মুহূর্তের জন্যে অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল ভিউ ফাইণ্ডার। পরমুহূর্তেই ইনস্ট্যান্ট রিটার্ন মিরর যথাস্থানে ফিরে গিয়ে ভেসে উঠল আবার মিত্রার ছবি। নিজের আসনে গিয়ে বসে পড়ল রানা। একটা সিনিয়র সার্ভিস। ধরাল। আগাগোড়া সবটা ব্যাপার ভেবে দেখা দরকার। পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে নিল ও।
…ক্ৰেধা আধা তেটে তেটে/কৎ তেটে ক্ৰেধা তেটে/ক্ৰেধা তেটে ধা/
ক্ৰেধা তেটে ধা/ক্রেধা তেটে/ক্রেধা আধা তেটে তেটে/
কৎ তেটে ক্ৰেধা তেটে/ক্রে তেটে ধা/
ক্ৰেধা তেটে/
ধা ধিন ধিন ধা/ধা ধিন ধিন ধা/না তিন তিন না/
তেটে ধিন ধিন ধা/…
মুখে চক্রধর বোল বলছে তবলচি। মিত্রা সেন এবার নাচের মুদ্রায় সে ছন্দকে মূর্ত করে তুলবে।চতুগুণ বেড়ে গেছে লয়। অত্যন্ত দ্রুত লয়ে চলছে নাচ।
হঠাৎ মনে হলো যেন মিত্রার পা আর মাটিতে নেই-সারাটা স্টেজময় যেন সে। হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। মুগ্ধ, চমৎকৃত দর্শকবৃন্দের করতালিতে হলের ছাদ উড়ে যাবার উপক্রম। রানাও অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল–প্রশংসা না করে পারল না মনে। মনে। সত্যিকার শিল্প দেশ-জাতি-ধর্মের ঊর্ধ্বে।
হাততালি থেমে যেতেই হলের মাঝামাঝি জায়গায় বসে এক ফাজিল ছোকরা ‘ম্যা…এ্যা…’ করে জোরে ছাগলের ডাক ডেকে উঠল। চাপা হাসির গুঞ্জন উঠল। দু’একটা ধমক-ধামকের আওয়াজও এল।
নাইকন-এফ-এর লেন্সটা খুলে ফেলল রানা। খুলে ২০০ মি.মি. আঁটো নিকর এফ ২.৫ টেলিফটো লেন্সটা লাগিয়ে নিল। বেয়োনেট মাউন্টের উপর ক্লিক করে বসে গেল লেন্স। এবার ক্যামেরাটা চোখে তুলে ফোকাস অ্যাডযাস্ট করতে চেষ্টা করল সে। টেলিফটো লেন্সের ছোট অ্যাঙ্গেলের মধ্যে মিত্রা সেনকে ধরতে কয়েক সেকেণ্ড লেগে গেল। নাইকন-এর উজ্জ্বল ভিউ-ফাইণ্ডারে পর্দায় পৃথিবীর অদ্বিতীয় নিকর লেন্সের মাধ্যমে পরিষ্কার ভেসে উঠল এবার মিত্রার সুন্দর মুখচ্ছবি। প্রতিটি রেখা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে রানা। উপলব্ধি করল ও, এ মুখটাও পৃথিবীতে অদ্বিতীয়। কপালে চাদির টিপ আলো পড়ে মাঝে মাঝে ঝিক করে উঠছে, দু’চোখে টেনে কাজল পরা, সুপুষ্ট লোভনীয় অধর লিপস্টিকে লাল।
সোজা তার দিকে চেয়ে আবার ইঙ্গিত করল মেয়েটি। না, চোখের ভুল নয়। দূর হলো রানার সন্দেহ।
প্রবল করতালি এবং শেয়ালের ডাকের মধ্যে নাচ শেষ হলো। কালো পর্দাটা ধীরে ধীরে নেমে এসে আড়াল করল মিত্রাকে হাজার দুয়েক লুব্ধ চোখের দৃষ্টি থেকে।
সবাই একসঙ্গে বেরোতে চাইছে হল থেকে। গেটের কাছে দারুণ ভিড় ঠেলে রানা এগোল গ্রীনরুমের দিকে। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ হাত ঢোকালো রানার প্যান্টের পকেটে। ধরতে পারল না রানা হাতটা। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল একটা লোমশ হাত সরে গেল পিছনের ভিড়ে।