মিত্রাও উঠে দাঁড়াল।
‘কেমন লোক আপনি? আপত্তির সুর মিত্রার কণ্ঠে। এই ঘরে একা আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছেন যে বড়? একা কী করে থাকব আমি এই জানালা ভাঙা ঘরে?
একটু ভেবে নিয়ে রানা বলল, ‘বেশ তো, আপনি আমার বিছানায় গিয়ে নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়ুন। আমি না হয় এই ঘরে আপনার পাহারায় থাকব।
‘আমার এৰ্মনিতেই আজ রাতে আর ঘুম আসবে না। আসুন না, আপনার ঘরে বসে গল্প করে কাটিয়ে দিই রাতটা?’
না। আপনার ঘুম না এলেও আমার ঘুম আসবে। ঘুরে দাঁড়াল রানা।
‘আপনি আমাকে তাড়াতে পারলেই বাঁচেন মনে হচ্ছে।’
‘হ্যাঁ।’
কারণ? অনুষ্ঠানের শেষে দুর্ব্যবহার করেছিলাম, তাই?
না। মিত্রার চোখের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে চাইল রানা। সেজন্যে নয়। কারণটা খুবই সাধারণ। আপনি সুন্দরী রমণী। আমি শক্তিশালী পুরুষ। এখন। অনেক রাত। বাইরে ঝমাঝম বৃষ্টি। এ ঘরে আপনি একা। আমি বহ্মচারী মহাপুরুষ নই। আমার মধ্যে পশু জেগে ওঠা কি একেবারেই অস্বাভাবিক?
মন দিয়ে কথাগুলো শুনল মিত্রা। বুঝল কথাটা বিশ্রী হলেও সত্য। মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল ওর। শুধু বলল, আপনি একটি ছোটলোক, তারপর হঠাৎ ঘুরে চলে গেল রানার ঘরে।
এক মিনিটের মধ্যেই আবার ফিরে এল মিত্রা। হাতে রানার ওয়ালথার পিপিকে পিস্তলটা।
‘এই নিরীহ শান্তিপ্রিয় বস্তুটি বালিশের তলায় থাকলে অস্বস্তি লাগছে। জিনিসটা আপনার কাছেই থাক-কোনও কাজে লেগে যেতে পারে।’
ঘণ্টা দেড়েক পার হয়ে গেল। বাতি নিভিয়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে উসখুস করছে রানা। কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছে না। বালিশে মিত্রার চুলের মেয়েলি সুবাস। মনে হচ্ছে বিছানায় এখনও লেগে আছে মিত্রার দেহের উত্তাপ। বৃষ্টি থেমে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ, তাই দ্বিগুণ জোরে শোনা যাচ্ছে ব্যাঙের ডাক। জানালার বাইরে। টিপ টিপ জোনাকির দীপ জ্বলছে, এখনও পুরোদস্তুর শহর হয়ে উঠতে পারেনি জায়গাটা।
একটা সিগারেট ধরাল রানা। লাইটার নেভাবার ঠিক আগের মুহূর্তে দেখতে পেল ও আবছা একটা লম্বা মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে ঠিক ঘরের মাঝখানে। হাতের পিস্তলটা ওর দিকে তাক করা। চমকে উঠল রানা।
‘এক বিন্দু নড়াচড়া করলেই খুলি ফুটো করে দেব,’ মৃদু অথচ গম্ভীর কণ্ঠস্বর। # মরার মত কাঠ হয়ে পড়ে থাকল রানা। অসতর্ক থাকার জন্যে ভয়ানক রাগ হলো নিজের ওপর। একবার ভাবল বালিশের তলায় পিস্তলটার কথা। কিন্তু এখন চেষ্টা করা বৃথা। দেখা যাক কী হয়।
‘কে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘তোমার যম!’ সংক্ষিপ্ত উত্তর।
এক পা এক পা করে পিছিয়ে গেল লোকটা। পিস্তলটা তেমনি ধরা। টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে দিল সে। লোকটার চেহারা দেখেই অবাক হয়ে উঠে বসল রানা বিছানার ওপর।
‘তুই! তুই শালা এত রাতে এ ঘরে ঢুকেছিস কী করতে?
উজ্জ্বল হাসিতে উদ্ভাসিত সোহেলের মুখ।
দিয়েছিলাম তো ঘাবড়ে, বোক-চন্দর? টেরও পেলি নে জলজ্যান্ত মানুষটা ঢুকলাম ঘরের ভেতর? কালই শালা তোর চাকরি খেয়ে দেব আমি দেখিস বুড়োকে বলে।
ওর একান্ত প্রিয় নাইন মিলিমিটার হ্যাঁমার লেস লুগার পিস্তলটা প্যান্টের নীচে তলপেটের কাছে লুকোনো হোলস্টারে ঢুকিয়ে দিল সোহেল।
‘আরে যা যা! তোর মত দশটা বয়-বেয়ারা আমার এক ডাকে ছুটে আসে, তা জানিস? তুই আমার কচু করতে পারবি। আর একটু হলে যেই হার্টফেলটা করতাম-বারোটা বেজে যেত তোর। কিন্তু দোস্ত, মনে হচ্ছে আজ রাতের সব ঘটনাই তোর জানা?’
‘স-অব, স-অব! সব দেখেছি তো আমি। আহাহা! তোর কপালে যখন জলপট্টি লাগাচ্ছিল না, উ-উ-হ! জিভ দিয়ে একটা বিশেষ শব্দ বের করল সোহেল। তখন আমার কী ইচ্ছে করছিল জানিস? মনে হচ্ছিল নিজেই নিজের। কপালে একটা ইট মেরে গিয়ে হাজির হই সামনে।
হাসল রানা। একটা সিগারেট ছুঁড়ে দিল সোহেলের দিকে। খপ করে সেটা ধরে নিয়ে হাতল-বিহীন একটা চেয়ারে উল্টো হয়ে বসল সোহেল। সিগারেটটা ধরিয়ে নিয়ে হঠাৎ বলল, আমার কথা হেড-অফিসের সবাই ভুলে গেছে, নারে? কেউ আমার কথা কিছু বলে না? একটা করুণ সুর ধ্বনিত হলো ওর কণ্ঠে।
বলবে না কেন? সবাই বলে।’ মিথ্যে কথা বলল রানা। নিত্যনতুন কাজের চাপে অতীতকে মনে রাখবার উপায় আছে? ও নিজেই তো প্রায় ভুলতে বসেছিল। তবু বলল, ‘কেন, তোর ওই সিঙ্গাপুর অ্যাসাইনমেন্ট-এর দৃষ্টান্ত দিয়ে সেদিন মেজর জেনারেল তো এক লেকচারই ঝেড়ে বসল আমাদের ওপর।
কেন জানি কথাটা অকপটে বিশ্বাস করল সোহেল। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ল ওর। বলল, ‘কী দিন ছিল, তাই না রে? তারপর হঠাৎ শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। কাছে এসে এক টানে রানার পট্টি খুলে দিল।
ন্যাকামি হচ্ছে, না? মাথায় ব্যাণ্ডেজ বেঁধে একেবারে সিনেমার হিরো! আঁ? খোল, শালা!’
কপালের আঘাতটা ভাল করে পরীক্ষা করে দেখল সোহেল। তারপর পকেট থেকে বের করল একটা মলমের কৌটো। কৌটোর নীচের দিকটা শক্ত করে চেপে ধরে রানার দিকে বাড়িয়ে দিল। ঢাকনিটা খুলে দিল রানা। কালো মত ওষুধ।
কী ওষুধ রে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘আইয়োডেক্স। ডাক-বাংলোর ফাস্ট-এইড বক্সে পেলাম। শিশিটা ভেঙে গেছে বলে বোধহয় এই কৌটোয় তুলে রেখেছে লেবেল লাগিয়ে।’
রানার কপালে লাগিয়ে দিল সোহেল মলমটা। তারপর আঙুল দুটো নির্দ্বিধায় রানার পরিষ্কার শার্টে মুছে নিয়ে পকেট থেকে গোটা দুই নোভালজিন ট্যাবলেট বের করে দিল।