ছিটকিনির অবস্থান আন্দাজ করে নিয়ে জোরে একটা লাথি মারল রানা বাথরুমের দরজায়। খুলে গেল কপাট। কেউ কিছু বুঝবার আগেই সামনের দু’জন লোক ধরাশায়ী হলো রানার প্রচণ্ড মুষ্ট্যাঘাতে। তৃতীয় জন ছুরি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে রানার উপর। প্রথমে ছোরাসুদ্ধ হাতটা ধরে ফেলল রানা, তারপর যুযুৎসুর এক প্যাঁচে আছড়ে ফেলল লোকটাকে মাটিতে। এবার দুই হাঁটু জড়ো করে ঝপাং করে পড়ল ওর পেটের ওপর। হুক করে একটা আওয়াজ বেরোল ওর মুখ দিয়ে; নড়বার আর শক্তি রইল না। কিন্তু রানা উঠে দাঁড়াবার আগেই প্রথম আক্রান্ত একজন উঠে এসে পেছন থেকে, সাপটে ধরল রানাকে। চতুর্থ লোকটি এবার কোমর থেকে টান দিয়ে একটা থ্রোয়িং নাইফ বের করল। মুখে বিজয়ীর হাসি।
আব কাঁহাঁ যাওগে, উল্লুকে পাটঠে।
রানার বুক বরাবর ছুরিটা ছুঁড়তে গিয়ে থমকে গেল সে। যেন যাদুমন্ত্রের বলে পেছনের লোকটা রানার সামনে চলে এসেছে। একটু হলেই সেইম সাইড হয়ে। যেত। নিতম্বের উপর রানার প্রচণ্ড এক লাথি খেয়ে হুমড়ি খেয়ে লোকটা গিয়ে পড়ল চতুর্থ জনের ওপর। টাল সামলাতে গিয়ে ছুরিটা পড়ে গেল হাত থেকে মাটিতে। আর মাটিতে পড়তেই পা দিয়ে এক ঠেলা দিয়ে মিত্রা সেটাকে পাঠিয়ে দিল ঘরের এক কোণে। খালি হাতেই ঝাঁপিয়ে পড়ল ভীষণ আকৃতির চতুর্থ লোকটা রানার ওপর। নাক বরাবর রানার গোটা দুই নক-আউট পাঞ্চ খেয়ে সে ছিটকে পড়ল জানালার ধারে।
রানা চেয়ে দেখল জানালার সবক’টা শিক বাঁকানো। এই পথেই প্রবেশ করেছে লোকগুলো। বাইরে ঝমাঝম বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেছে কখন ও টেরই পায়নি। কী করবে ভাবছে রানা, এমন সময় বাইরের অন্ধকার থেকে মস্ত একখানা ঢিল ছুটে এসে খটাশ করে লাগল ওর কপালে। আঁধার হয়ে গেল রানার চোখ। পড়ে যাচ্ছিল, চেয়ারের হাতল ধরে সামলে নিল। মাথাটা আঁ আঁ করছে। কিন্তু জ্ঞান হারিয়ে ফেললে চলবে না। এখন জ্ঞান হারালে নিশ্চিত মৃত্যু।
যেন বহুদূর থেকে কয়েকটা কথা কানে এল রানার।
‘সালা ডাকু হ্যায়। মার ডালেগা। ভাগো! ভাগো স্যবলোগ ইয়াহসে!’
সেকেণ্ড চারেক পাজর বরাবর একটা ছুরির আঘাত এবং তীব্র এক ঝলক ব্যথা আশা করল রানা। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটল না। মাথাটা একবার ঝাঁকিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল ও। তখনও ঘুরছে মাথাটা। চেয়ে দেখল চারজন মুখোশধারীই অদৃশ্য হয়ে গেছে। মিত্রা ছাড়া ঘরে কেউ নেই। ছুটে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াল রানা। বৃষ্টির ছাট লাগল চোখে-মুখে। একটু পরেই দেখল বড় রাস্তা। দিয়ে একটা গাড়ি সোজা চলে গেল উত্তর দিকে সামনের অনেকদূর পর্যন্ত আলোকিত করে। মিত্রাও পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘চলে গেল?
তাই তো মনে হচ্ছে।’
ঘরের এক কোণ থেকে ছুরিটা তুলে নিয়ে মিত্রা সেনের হাতের বাঁধন কেটে দিল রানা। হাত ছাড়া পেয়ে প্রথমেই নগ্ন বুক দুহাতে ঢাকল মিত্রা। তখনও থর থর করে কাঁপছে সারা অঙ্গ। আলনা থেকে একটা ব্লাউজ টেনে ছুঁড়ে দিল রানা ওর দিকে। তারপর বলল, ‘আপনি জামাটা পরে ফেলুন, আমি আপনার জন্যে একটু উইস্কি নিয়ে আসছি। বাথরুমের মধ্য দিয়ে নিজের ঘরে চলে এল রানা।
সুটকেস থেকে বোতল বের করে আধ গ্লাস উইস্কি ঢেলে নিয়ে পাশের ঘরে এল রানা। দেখল কাপড় পরে বিছানার ওপর বসে আছে মিত্রা সেন আড়ষ্ট ভঙ্গিতে।
‘টুক করে এটুকু খেয়ে ফেলুন, আমি মৈত্র মশাইকে ডেকে আনছি।’
চট করে একবার রানার চোখের দিকে চেয়ে নিল মিত্রা সেন। তারপর গ্লাসটা নিয়ে একহাতে নাক টিপে ধরে তিন ঢোকে খেয়ে ফেলল উইস্কিটুকু। রানা ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, কী মনে করে মিত্রা ডাকল, ‘শুনুন।
কী?
‘মৈত্র মশাইকে ডাকা যাবে পরে। এখন এই চেয়ারটায় বসুন তো, কপালটা অসম্ভব ফুলে গেছে, জলপট্টি লাগিয়ে দিই। তা ছাড়া মৈত্র মশাই এসে এখন আহা-উঁহু ছাড়া আর কী করবেন?
একটা রুমাল চার ভাজ করে এক মগ পানিতে ভিজিয়ে ভিজিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ফোলা জায়গাটায় ধরল মিত্রা, তারপর ভেজা রুমালটা কপালে বসিয়ে আরেকটা কাপড় দিয়ে বেঁধে দিল রানার মাথাটা।
‘মৈত্র মশাইকে ডাকার কোনও দরকার নেই, হঠাৎ বলে উঠল মিত্রা। ‘বিপদগ্ৰস্তা ভদ্রমহিলার জন্যে নিরীহ শান্তিপ্রিয় ফটোগ্রাফারের কাছাকাছি থাকাই বেশি নিরাপদ।
ভাবছি, এই লোকগুলো কে। আপনি চেনেন এদের? আপনাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল কোথায়?
‘আমি কিচ্ছু জানি না। কোনদিন দেখিনি এদের।
সাধারণ গুণ্ডা বলেই তো মনে হলো। কিন্তু কোনও আভাসই পাননি আপনি, এটা কেমন কর্থা?
‘এমনি কানাঘুষোয় শুনেছি, একটা বদমাশের দল আছে, ইয়াং টাইগারস না কী একটা নাম-ওরা নাকি তোক লাগিয়েছে, সুযোগ পেলেই আমাকে ধরে নিয়ে যাবে ওদের আড্ডায়। তেমন কোনও গুরুত্ব দিইনি ওসব কথার।
ইয়াং টাইগারস-এর নাম শুনে একটু কঠিন হয়ে গেল রানার মুখ। পর মুহূর্তেই স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, আপনার দলের কাউকে যদি ডাকতে বলেন তো ডেকে দিতে পারি। আর নইলে আপনি বিশ্রাম করুন, আমি আমার ঘরে যাই। রাত এখনও অনেক বাকি আছে, এভাবে গল্প করলে কাটবে না।’
উঠে দাঁড়াল রানা। ঝমঝম অবিরাম বৃষ্টি পড়ছে এখনও। কাছেই কোনও পুকুরে ব্যাঙ ডাকছে কা-কোকা-কো একঘেয়ে সুরে। বিজলী চমকে উঠল আকাশ চিরে।