হঠাৎ একটু খুট আওয়াজ হতেই চোখ মেলে রানা চেয়ে দেখল হাসছে সোহেলের উজ্জ্বল দুই চোখ। এতদিন পর রানাকে পেয়ে আনন্দে উদ্ভাসিত। কাঁধে একটা দেড় টাকা দামের ছোট্ট টাওয়েল। বয়-বেয়ারার সাদা ড্রেস পরা। কোমরের বেল্টে পিতলের মনোগ্রামে লেখা KUSHTIA REST HOUSE..
কী নাম হে তোমার, ছোকরা?’ খুব ভারিক্কি চালে জিজ্ঞেস করল রানা।
দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট চেপে ধরে চোখ পাকিয়ে প্রথমে ঘুসি দেখাল সোহেল, তারপর বিনয়-বিগলিত কণ্ঠে বলল, ‘আজ্ঞে, রাখাল দাশ। চার নম্বর বলেও ডাকতে পারেন।’ বুকে আঁটা নম্বর দেখাল সে।
‘বেশ, বেশ। ঘরটায় চট করে ঝাড় লাগিয়ে দাও তো, বাবা রাখাল। বড় নোংরা হয়ে আছে। চোখ টিপল রানা; ভাবটা কেমন জব্দ!
সোহেল দেখল ওকে বেকায়দা অবস্থায় পেয়ে খুব এক হাত নিচ্ছে রানা। হেসে ফেলল সে। বলল, ‘আজ্ঞে, এখন ঝাঁট দিলে ধুলোয় টিকতে পারবেন না। আপনি বাইরে যাবার সময় চাবিটা দিয়ে যাবেন, পরিষ্কার করে দেব সব নোংরা।
‘তাই দিয়ে। এখন চা-টা কী খাওয়াবে খাওয়াও দেখি জলদি। সন্ধের দিকে। একটু বাইরে যাব ঘণ্টা খানেকের জন্যে।
ইঙ্গিতটা বুঝল সোহেল। বাইরে মানে সোহেলের বাংলো। হেড-অফিসের। সঙ্গে কথা আছে বোধহয়। নীরবে বেরিয়ে গেল সে ঘর থেকে।
হাঁটার সময় সোহেলের ডান হাতটা দুলছে, বাঁ হাতটা স্থির হয়ে রয়েছে দেখে খচ্ করে তীব্র একটা বেদনার খেচা বিঁধল রানার বুকে। একসময় রাহাত খানের সবচাইতে প্রিয়পাত্র ছিল ওরা দুজন। বক্সিং, যুযুৎসু, পিস্তল ছোঁড়া, শক্তি, বুদ্ধি, সাহস, সব, ব্যাপারেই দুজন কেউ কারও চেয়ে কম যেত না। নিজেদের মধ্যে যেমন ছিল ওদের তীব্র প্রতিযোগিতা, তেমনি ছিল গভীর বন্ধুত্ব। কিন্তু ভাগ্য সোহেলের উপর বিরূপ। একবার একটা অ্যাসাইনমেন্ট-এ চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ে পাথরে পা পিছলে টাল সামলাতে না পেরে চাকার তলায় কাটা পড়ল বাম হাত। একেবারে ছাটাই না করে বিপজ্জনক কাজ থেকে সরিয়ে ওকে যশোর-কুষ্টিয়া ব্রাঞ্চের হেড করে দিয়েছেন রাহাত খান। কে জানে, হয়তো একদিন রানারও এমনি অবস্থা হবে। নিজের অজান্তেই ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল রানার বুক চিরে।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ট্রে-তে করে এক পট চা আর কিছু বিস্কিট নিয়ে ফিরে এল সোহেল। রানার পাশে টিপয়টা টেনে দিয়ে সেগুলো নামিয়ে রাখতে রাখতে চাপা গলায় বলল, ‘তোকে চিনে ফেলেছে ওরা, রানা! আমার যদ্র বিশ্বাস জেনে গেছে ওরা তোর পরিচয়। জয়দ্রথ মৈত্রের কাছ থেকে এক টুকরো কাগজ নিয়ে ওদের দলের একজন প্রত্যেক ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবাইকে সাবধান করে দেয়া হচ্ছে খুব সম্ভব। আমি এখনও ওদের সন্দেহের বাইরে আছি। হিন্দু বলে বিশেষ ফেভারও পাচ্ছি।’ একটা চাবি বের করল সোহেল পকেট থেকে। এই নে, আমার ওয়ায়ারলেস রুমের চাবি। আমি সন্ধের সময় বেরোতে পারব না। তুই সোজা রেলস্টেশনে চলে যাবি। ওখান থেকে আমার লোক তোকে নিয়ে যাবে বাড়িতে। রাতে আমি নজর রাখব, আর হঠাৎ যদি দরকার মনে করিস, এই বেল টিপে দিস। আজই সকালে লাগিয়েছি। খাটের পায়ায় লাগানো গোপন কলিং,
বেলের সুইচ দেখিয়ে দিল সোহেল। |||||||||| বেশ জমিয়ে নিয়েছিস দেখছি, দোস্ত!’ সপ্রশংস দৃষ্টিতে চাইল রানা ওর দিকে। কিন্তু সেই সঙ্গে জুড়ে দিল, ‘দেখিস, ভুলে যাস না আবার, আমি বেরিয়ে গেলেই ঘরটায় একহাত ঝাড় লাগিয়ে দিস, বাবা!’ চোখে-মুখে দুষ্টামির হাসি। রানার।
যা-যাহ, বাজে বকিস না। ফাই-ফরমাশ খাটতে খাটতে জান বেরিয়ে যাবার জোগাড় হয়েছে। পিঠটা বাকা হয়ে গেছে আমার। ঘর ঝাড় দেব না, শালা। বেঁটিয়ে তোর বিষ ঝেড়ে দেব।’
বেরিয়ে গেল সোহেল। আবার রানার চোখে পড়ল, বাম হাতটা স্থির হয়ে। ঝুলছে সোহেলের। কিন্তু দমে যায়নি মানুষটা। তেমনি হাসি খুশি চেহারা, বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জ্বল দুই চোখ। হার মানেনি ও ভাগ্যের কাছে।
রাতে মিত্রা সেন সত্যিই মুগ্ধ করল রানাকে। নৃত্যকলাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকৃতি দিল ও এই প্রথম। কিন্তু নাচের শেষে অকুণ্ঠ প্রশংসা করতে গিয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে হলো রানাকে। পরিষ্কার ঘৃণা প্রকাশ পেল মিত্রার ব্যবহারে। আহত রানা বুঝল, সত্যিই ধরা পড়ে গেছে ও। ঢাকা এয়ারপোর্টের সেই সানগ্লাস পরা ছোকরাকে অবজ্ঞা করা তার উচিত হয়নি।
.
০৪.
২৯ আগস্ট, ১৯৬৫।
অনেক রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। ঠিক বিড়ালের মত চোখ মেলে চাইল রানা। ঘুমের লেশামত্র নেই সে চোখে। যেন জেগেই ছিল এতক্ষণ। আবছা একটা ধস্তাধস্তির শব্দ এল কানে। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসল ও বিছানার উপর। আন্দাজে বুঝল শব্দটা আসছে মিত্রা সেনের ঘর থেকে।
নিঃশব্দে বাথরুমের ছিটকিনি খুলে পা টিপে টিপে মিত্রার ঘরের দিকের দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াল রানা। মৃদু আলো আসছে মিত্রার ঘর থেকে। একটা ফুটোয় চোখ রেখেই তাজ্জব হয়ে গেল সে। চোখটা একবার কচলে নিয়ে আবার রাখল ফুটোতে। সেই একই দৃশ্য। টেবিল ল্যাম্পটা মাথা নিচু করে জ্বালানো, আছে টেবিলের ওপর। সেই আলোয় দেখা গেল চারজন ষণ্ডামার্কা মুখোশধারী লোকের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছে মিত্রা সেন। মুখে রুমাল পুরে চিৎকারের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে আগেই। এবার দু’হাত পেছনে নিয়ে দুই কনুই একসঙ্গে টেনে বেঁধে ফেলা হলো। আঁচল খসে পড়ে শাড়িটা লুটোপুটি খাচ্ছে মাটিতে। কিন্তু সমানে পা চালাচ্ছে মিত্রা। সামনের লোকটার তলপেট বরাবর ঝেড়ে একটা লাথি মারল সে। দু’পা পিছিয়ে গেল লোকটা। হঠাৎ পাশ থেকে ছুরি ধরা একজন লোক এগিয়ে এসে বাঁ হাতে ওর ব্লাউজটা একটানে ছিঁড়ে ফেলল। তারপর বুকের উপর চোখা ছুরিটা মারাত্মক ভঙ্গিতে ঠেসে ধরে নিচু গলায় কানের কাছে কিছু বলল। স্থির হয়ে গেল মিত্রা সেন। আর বাধা দেবার চেষ্টা করল না। চোখ দুটো ভয়ে বিস্ফারিত। নিজের অসহায় অবস্থার কথা চিন্তা করে জল গড়িয়ে পড়ল ওর চোখ থেকে।