- বইয়ের নামঃ ভারতনাট্যম ১
- লেখকের নামঃ কাজী আনোয়ার হোসেন
- সিরিজঃ মাসুদ রানা
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ অপরাধ, রোমাঞ্চকর গল্প, কল্পকাহিনী, গুপ্তচর, অ্যাকশন
ভারতনাট্যম ১
০১.
৩০ আগস্ট, ১৯৬৫।
‘এবারে কথক নৃত্য পরিবেশন করছেন শ্রীমতী মিত্রা সেন।
ঘোষকের মিষ্টি গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল। সঙ্গে সঙ্গেই গিজগিজে ঠাসা প্রকাণ্ড হলঘরের প্রচণ্ড কোলাহল মৃদু গুঞ্জনে পরিণত হলো। হল কাঁপিয়ে বেজে উঠল তবলার তেহাই।
তিক ধা ধিগি ধিগি থেই/তিক ধা ধিগি ধিগি থেই/
তিক ধা ধিগি ধিগি/
ধা ধিন ধিন ধা/ধা ধিন ধিন ধা/না তিন তিন না/
তেটে ধিন ধিন ধা/…
একটা একটা করে সব বাতি নিভে গেল হলের মধ্যকার। স্তব্ধ প্রতীক্ষায় উন্মুখ হয়ে উঠল দর্শকবৃন্দ। নিশ্চুপ হয়ে গেল মস্ত হলঘরটা।
কালো স্ক্রিন সরে যেতেই প্রথমে লাল, পরে হালকা নীল আলো ঝিলমিল করতে থাকল ঢেউ খেলানো সিল্কের সাদা পর্দার উপর। তারপর সে পর্দাও দু’ফাঁক হয়ে সরে গেল ধীরে ধীরে। দেখা গেল নমস্কারের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে কলকাতার সাংস্কৃতিক শুভেচ্ছা মিশনের সর্বশ্রেষ্ঠ আকর্ষণ, অতুলনীয়া সুন্দরী নর্তকী শ্রীমতী মিত্রা সেন। স্পট লাইটের স্বপ্নিল আলো একটা মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করেছে মিত্রা সেনকে ঘিরে। উদ্ভিন্ন যৌবনাক্ষীণ কটি-কাজল-কালো হরিণ চোখ। এক শ্রেণীর দর্শকদের মধ্য থেকে একটা আধা-অশ্লীল উল্লাস ধ্বনি উঠেই মিলিয়ে গেল।
তা তে থেই তাত/আ তে থেই তাত থেই আ থেই আ থেই/
থেই থেই তাত তাত থা/তেরে কেটে গদি ঘেনে ধা আ/
তেরে কেটে গদি ঘেনে ধা আ/তেরে কেটে গদি ঘেনে/
ধা ধিন ধিন ধা/ধা ধিন ধিন ধানা তিন তিন না/
তেটে ধিন ধিন ধা/…)
আরম্ভ হলো নাচ। শতকরা নব্বই জন দর্শকই সেই মুহূর্তে মনে মনে স্থির করল, যে করে হোক আগামী দিনের টিকেট জোগাড় করতে হবে–ব্ল্যাকে দশগুণ দাম দিয়ে হলেও।
হলঘরের অসহ্য ভ্যাপসা গরমে ফটোগ্রাফারের জন্যে নির্দিষ্ট আসনে বসে ঘামছে মাসুদ রানা। আর মনে মনে পিণ্ডি চটকাচ্ছে ঢাকায় এয়ারকণ্ডিশণ্ড-রুমে সুখে নিদ্রামগ্ন পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের কর্ণধার মেজর জেনারেল রাহাত খানের। যত সব রদ্দি পচা কাজের ভার বুড়ো বেছে বেছে ওর কাঁধে চাপায়। কেন? আর লোক নেই? ইণ্ডিয়ার নাম শুনলেই একেবারে যেন বাই চড়ে যায়। বুড়োর মাথায়। ডন কুইকজোটের মত খেপে গিয়ে হাওয়ায় তলোয়ার ঘোরাতে আরম্ভ করে দেয় একেবারে।
আরে বাবা, একদল ন্যাকা মেয়েছেলে আর তাদের সঙ্গে মেয়েলী স্বভাবের মিনমিনে কতকগুলো ননীর পুতুল পুরুষ এসেছে কলকাতা থেকে গায়ক-গায়িকা নর্তক-নর্তকী সেজে। এদের মধ্যে তাকে ঢোকাল বুড়ো কোন আক্কেলে? তাও যদি জার্নালিস্ট বা অন্য কোনও পরিচয় হত তো এক কথা। তা নয়। তার কাজ কী?–না ফটোগ্রাফি। এখন যে গরম লাগছে, তার কী হবে? পচা গরমে ঘামতে ঘামতে হঠাৎ পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে উঠল রানার। সব রাগ গিয়ে পড়ল। রাহাত খানের উপর। দু’মিনিটের চেষ্টায় অনেক কষ্টে জোর করে দূর করে দিল। রানা মন থেকে সব বিক্ষোভ।
ভাদ্রের প্রায় মাঝামাঝি। শরৎ কাল। কিন্তু এবারের শরৎ যেন গুমোট ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। প্রিয়ার আঁখির মত নীল আকাশ, পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা মেঘের অক্লেশে হাওয়ায় ভেসে যাওয়া, মাঝে মাঝে উত্তর থেকে অনেক স্মৃতি জাগিয়ে তোলা নীলুয়া বাতাস, সন্ধ্যেবেলায় পুজোর ঘণ্টা, শিউলির জমাট সুগন্ধ, আমেজ–সবই আছে। কিন্তু গরমটা যেন চেপে বসেছে গদির উপর; নড়বে না কিছুতেই।
তার উপর সিগারেটের ধোঁয়া আর এতগুলো লোকের আড়াই ঘণ্টা ধরে। অবিরাম নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে ভারী হয়ে উঠেছে রাজশাহী টাউন হলের বদ্ধ বাতাস। কতক্ষণ আর সহ্য করা যায়? চোখ দুটো অল্প অল্প জ্বালা করছে রানার। সম্মোহিত দর্শকবৃন্দের দিকে একবার নির্লিপ্ত দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল ও। একটা থামের গায়ে হেলান দিয়ে নিজেও একটা সিগারেট ধরাল।
রানার বাঁ কাঁধে ঝুলছে ব্রাউন হবি EL 300 ইলেকট্রনিক ফ্ল্যাশ গান এবং বিভিন্ন ফোকাল লেংথের নিকর লেন্স, ফিল্টার, এক্সট্রা লেন্স-হুঁড়, কেবল-রিলিজ, একটা মোটর ড্রাইভ এবং অন্যান্য হাবিজাবিতে ভর্তি একখানা গ্যাজেট ব্যাগ; আর ডান কাঁধে টু-পয়েন্ট এইট লেন্সের একটা রোলিফ্লেকস ক্যামেরা। গলায় ঝুলছে একখানা বিখ্যাত নাইকন-এফ ক্যামেরা। লেন্স-হুঁডটা লাগানোই ছিল তাতে। দ্রুত ফোকাস করবার জন্যে স্পিট ইমেজ রেঞ্জ ফাইণ্ডার স্ক্রিন ব্যবহার করছে ও আজ।
পাকা ফটোগ্রাফারের বেশে নিজেকে কেমন বিদঘুঁটে দেখাচ্ছে কল্পনা করে। মুচকি হাসল রানা। তারপর ফ্ল্যাশ-গানটা ধীরে-সুস্থে ক্যামেরার উপর লাগিয়ে নিল। আড়চোখে একবার চেয়ে দেখল, সেই ছয়জন ইয়াং টাইগারস-এর মধ্যখানে বসে আছে সাংস্কৃতিক মিশনের দলপতি জয়দ্রথ মৈত্র। স্টেজের দিকে ওদের কারও চোখ নেই-চাপা গলায় কী যেন আলাপ করছে নিজেদের মধ্যে। নাইকন-এফ ক্যামেরায় অ্যাপারচার এফ এইট দিয়ে ডিসট্যান্স বিশ ফুটে সেট করে নিল রানা। এতে ডেপথ অভ ফোকাস ৯ ফুট থেকে ইনফিনিটি পাওয়া যাবে। আধ-খাওয়া সিগারেটটা মাটিতে ফেলে পিষে ফেলল ও জুতো দিয়ে। জমে উঠেছে নাচ।