‘মিসখা এয়ার কণ্ডিশন করেছে নাকি? জিজ্ঞেস করলেন রাহাত খান।
না, স্যর, কোনও কোনও ঘরে এয়ার কুলার লাগিয়ে দিয়ে দশ টাকা চার্জ বেশি নেয়।’
‘হ্যাঁ, যা বলছিলাম, রানা, কাজের কথায় এলেন আবার খান সাহেব, ‘তোমরা পৌঁছবে সেখানে সন্ধ্যে সোয়া সাতটার দিকে। মেয়েটা যখনই প্যাকেটগুলো পৌঁছবার জন্যে নীচে নামবে লিফটে করে, তুমি সঙ্গে সঙ্গে নেমে আসবে সিঁড়ি বেয়ে। সামনের রাস্তাটা পার হয়েই দেখবে চালকবিহীন একটা নীল রঙের ওপেল রেকর্ড স্টার্ট দেয়া অবস্থায় রাখা আছে রাস্তার উপর। ওই গাড়িতে করে পিছু নেবে মেয়েটির। এরপর কীভাবে এগোবে তা স্থির করার ভার তোমার উপরই থাকবে। চিটাগাং-ঢাকা ডাইরেক্ট টেলিফোন লাইন থাকায় তোমার সঙ্গে আর ওয়্যারলেস সেট দিচ্ছি না। যখনই প্রয়োজন তখনই রিং করবে।’
ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়ে উঠতে যাচ্ছিল রানা, চোখের পাতা নামালেন। এবং সেই সঙ্গে তর্জনী দিয়ে সিগারেটের উপর লম্বালম্বিভাবে একটা টোকা দিয়ে। ছাই ঝাড়লেন খান সাহেব। তার মানে ‘উঠো না, আর একটু বসো।’ শেষ একটা টান দিয়ে অ্যাশট্রেতে সিগারেটের টুকরোটা ফেলে বোতাম টিপলেন রাহাত খান। উপরের পাতাটা দু’ভাগ হয়ে ভিতরে চলে গেল টুকরোটা। ছাৎ করে একটা শব্দ হলো ভিতর থেকে, আর পাতলা এক ফালি ধোয়া বেরিয়ে এল কোনও এক ফাঁক গলে।
‘আর একটা কথা,’ এতক্ষণ পর আন্তরিকতার ক্ষীণ একটু হাসির আভাস পাওয়া গেল রাহাত খানের মুখে, বলা যায় না, আমাদের অজ্ঞাতে কোনও উপায়ে অপরপক্ষ জেনে ফেলতে পারে যে তুমি সুবীর সেন নও। হয়তো এখুনি সবকিছু জেনে ফেলেছে ওরা এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছে। বিপদের ঝুঁকিটা কতখানি বুঝতে পারছ তো? কাজেই খুব সাবধান থাকবে। আর সব রকম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকবে। যাও এখন।’
কথাগুলো শোনাল, ছোটকালে বাইরে কোথাও পাঠালে মা যেমন বারবার করে বলে দেন, দেখিস খোকা, গাড়ি ঘোড়া দেখে চলিস। আর রাস্তার ডানধার ঘেঁষে হাঁটবি, বুঝলি?’ ঠিক তেমনি।
মৃদু হেসে রানা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। হঠাৎ যদি ও পিছন ফিরত, তা হলে দেখতে পেত তার সুঠাম দীর্ঘ একহারা চেহারার দিকে সস্নেহ দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। মেজর জেনারেল (অব) রাহাত খান।
৩
আইডাব্লিউটিএ ফেরিটা দাউদকান্দি পৌঁছুল দেড়টার সময়। তারপর একটানা পথ। মেঘবিহীন খর-বৈশাখের দুপুর। অসহ্য গরম বাতাস আগুনের হল্কার মত জ্বালা ধরায় চোখে-মুখে। এমন দিনে এত বেলায় শখ করে কেউ ঢাকা থেকে চিটাগাং যায় না। কেউ নিতান্ত ঠেকায় পড়লে ভোর বেলার ফেরিতে পার হয়ে দেড়টা দুটোর মধ্যে পৌঁছে যায় চট্টগ্রামে। তাই মাসুদ রানার সহযাত্রী অন্য একটা গাড়িও নেই যে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দূর পথ চলার একঘেয়েমি কাটাবে। মাঝে মাঝে কেবল এক আধটা বাস বা ট্রাক আসছে সামনে থেকে-একরাশ ধুলো উড়িয়ে চলে যাচ্ছে দাউদকান্দির দিকে। রাস্তায় লোকজনের চলাচল এত কম যে মাঝে মাঝে হঠাৎ ধোকা লাগে: কে আমি, কোথায় চলেছি! গাড়ির ভিতরের ভ্যাপসা গরমে মাথাটা ঘুরে উঠতে চায়।
কুমিল্লায় পৌঁছে ট্যাঙ্ক ভর্তি করে পেট্রল নিয়ে নিল মাসুদ রানা। গাড়ি থামালেই বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে রানার দৃঢ় দুই বাহুর লোমকুপগুলো ঘিরে, জুলফির ভিতর দিয়ে ঘাম গড়িয়ে নীচে নামতে আরম্ভ করে, আর সুড়সুড়ি লাগে। আবার ষাট-পঁয়ষট্টি-সত্তর-আশিতে ওঠে স্পীড মিটারের কাঁটা। ৪০ মাইলের গড়পড়তা ঠিক রাখতে। তখন নোনতা ঘামে-ভেজা শরীরটা শুকিয়ে চড়চড় করে।
ঝির ঝির করে এয়ার কুলড ইঞ্জিনের একটানা একঘেয়ে শব্দ, আর গাড়ির নীচ দিয়ে কার্পেটের মত কালো পিচের রাস্তাটার অনবরত পিছনে সরে যাওয়া। মাঝে মাঝে এক আধটা শিরীষ কি অশ্বথ গাছ ঝুঁই করে চলে যাচ্ছে পিছনে। রাস্তার পাশে নিচু জায়গায় যেখানে অল্পস্বল্প পানি আছে, সেখানে কিছু সাদা বক ধৈর্যের সঙ্গে মাছের অপেক্ষায় এক পায়ে দাঁড়ানো।
রানা ভাবছে, যদি আসল ঘটনা প্রতিপক্ষ জেনে গিয়ে থাকে তবে বসন্তপুর বা চোদ্দগ্রামে গিয়ে কী দেখবে ও। হয়তো ইপিআর বা মেয়েটির কোনও চিহ্নই পাওয়া যাবে না রাস্তায়। এমনও হতে পারে সেনকে বন্দি করার পাল্টা জবাব হিসেবে ওকে ধরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করবে সৈন্যরা। যা হবার তাই হবে-মাথা থেকে এসব বাজে চিন্তা তাড়াবার চেষ্টা করল রানা। খুব সম্ভব এত শিগগির ওরা টের পায়নি সুবীর সেনের ব্যাপার। কিন্তু নিজের অজান্তেই আবার ভাবতে লাগল ও, যদি সৈন্যরা কোনও রকম সিগনাল বা কোডওয়ার্ড আশা করে ওর কাছ থেকে পরিচিতি হিসেবে, তখন কী করবে ও? তখনই তো হাতে নাতে ধরা পড়ে যাবে ও। সে দেখা যাবেখন। আবার চিন্তাটাকে দূর করে দিল রানা। কোড থাকলে জানাত চিঠিতে।
এবার পথের দিকে মন দিল ও। ভাগ্যিস চিটাগাং-ফেনি-কমিল্লা-দাউদকান্দি বাস সার্ভিস রয়েছে; তাই মাঝে মাঝে পথের সাথী’, ‘গ্রীন অ্যারো’, ‘টাইগার এক্সপ্রেস’ বা ‘দুল দুল’ লেখা এক আধটা বাসের দেখা পাওয়া যায়, আর হাফ ছেড়ে বাঁচে রানা।
আচ্ছা, মেয়েটা দেখতে কেমন হতে পারে? স্বামী-স্ত্রী হিসেবে একই ঘরে সিট রিজার্ভ করবার অর্থ কি? সুবীর সেনের প্রশংসনীয় কাজের পুরস্কার হিসেবে আসছে না তো মেয়েটা!-আপন মনেই মুচকি হাসল রানা।