আরেকটা সিগারেট ধরাবার জন্যে থামলেন রাহাত খান। সেই ফাঁকে রানা। জিজ্ঞেস করল, ‘চিঠিটা আমাদের হাতে এল কী করে, স্যর?’
চোখে ধোয়া যাওয়ায় চোখ দুটো পেঁচিয়ে উপর দিকে ঘুরিয়ে রাহাত খান ঠোঁট থেকে আঙুলের ফাঁকে সিগারেট নিয়ে বললেন, হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে ডাক্তার ওর পকেট থেকে এ চিঠি পেয়ে পুলিশকে দিয়েছে। পুলিশ সে কোড ব্রেক করতে না পেরে ভোর সাড়ে চারটায় আমাদের কাছে পাঠিয়েছে। আমাদের কোড এক্সপার্ট আধ ঘণ্টায় সে কোড ব্রেক করে আমার কাছে জরুরী টেলিফোন করেছে। এগুলো রুটিন ওয়ার্ক। এখন তোমার কাজটা বুঝিয়ে দিচ্ছি তোমাকে। শোনো, সুবীর সেন এখন আমাদের হাতের মুঠোয়; এয়ার হোস্টেসকে চিনে বের করা আমাদের বিশ মিনিটের কাজ; ইপিআর-এর ছদ্মবেশে ভারতীয় সৈন্যদের এবং সেই মহিলা গুপ্তচরকে আমরা অনায়াসে বামাল গ্রেপ্তার করতে পারি। এসব কাজ মোটেই কঠিন নয়। কিন্তু এসব করলে আসল সূত্রটা যাবে হারিয়ে। আমি জানতে চাই ভারতের এই গোপন তৎপরতার আসল উদ্দেশ্য কী-গোড়াটা • কোথায়। প্যাকেটে করে কী জিনিস চালান হচ্ছে, যাচ্ছে কার কাছে, এবং কেন। বুঝতে পেরেছ?’
মাথা ঝাঁকাল রানা। এত কথার মধ্যে এবার বেশ পরিষ্কার হয়ে এল আসলে তার কাজটা কী।
‘আজই বুধবার। এখন ঘড়িতে নটা বাজতে পাঁচ। এবার একটু চাঞ্চল্যের রেশ পাওয়া গেল রাহাত খানের কণ্ঠে। ঠিক এগারোটায় নারায়ণগঞ্জ ফেরিঘাটে পৌঁছতে হবে তোমাকে সুবীর সেনের পরিচয়ে। একটা সাদা ফোক্সভাগেনের সামনে-পিছনে সেনের গাড়ির নাম্বার প্লেট লাগানো হয়ে গেছে এতক্ষণে। দু’ঘণ্টার মধ্যে তৈরি হয়ে সেটা নিয়ে তুমি রওনা হবে চিটাগাং-এর পথে।
কথাটা বলে আধ মিনিট খানেক সমস্ত ব্যাপারটা মনে মনে পর্যালোচনা করে দেখলেন রাহাত খান অন্যমনস্কভাবে। তারপর আবার বললেন, ‘আসল সুবীর সেন যে আমাদের হাতে বন্দি হয়েছে, সে খবর সম্পূর্ণ চেপে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেনকে সোয়া পাঁচটার দিকে মেডিকেল কলেজ থেকে সরিয়ে আর্মি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওর গাড়িটা মিলিটারি, ক্রেন দিয়ে তুলে নিয়ে। যাওয়া হয়েছে, আগেই বলেছি। হোটেল ক্যাসেরিনায় টেলিফোন করে বলে দেয়া হয়েছে, ‘সেন সাহেব আমাদের বাসায় রাত কাটিয়েছেন; বেশি রাত হয়ে যাওয়ায় কাল রাতে আর হোটেলে ফিরতে পারেননি। আজ জরুরী কাজে চিটাগাং চলে যাচ্ছেন-দু’একদিন পর ফিরবেন, তা-ও আরও নিশ্চিত হবার জন্যে অ্যাংলো ম্যানেজার এডি কোস্টারকে ডেকে পাঠিয়েছি এখানে-একটু টিপে দিলেই সব পরিষ্কার বুঝবে ছোকরা। কাজেই সেনের দুর্ঘটনার খবরটা চাপা পড়ে যাচ্ছে। বর্ডারের সৈন্যরা বা মেয়েটি টের পাচ্ছে না কিছুই, সাবধানও হতে পারছে না।’
কিন্তু, স্যর, যে কোনও একজন ওয়াচার কি যথেষ্ট ছিল না? আমাকে পাঠাচ্ছেন কেন?’ রানা আরেকটু পরিষ্কার করে জানতে চায় সব কথা।
তার কারণ, চিঠিটা পড়ে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে বিরাট কোনও পরিকল্পনার প্রায়। সমাপ্তির দিকে চলে এসেছে ওরা। সুচিন্তিত সুষ্ঠু আয়োজন দেখছি সবদিকে। তাই পাঠাচ্ছি তোমাকে। আগাগোড়া সমস্ত ব্যাপার জানতে হবে তোমার-কী আছে। প্যাকেটে; কাকে দেয়া হচ্ছে সেটা; আর কেন দেয়া হচ্ছে। বুঝেছ?’
‘জী, স্যর। মাথা ঝাঁকাল রানা।
‘ওদের সমস্ত কুমতলব বানচাল করে দিতে হবে আমাদের। তাই আমাদের সবচেয়ে…’ বলেই ব্রেক চাপলেন জেনারেল, মানে, মোটামুটি একজন বুদ্ধিমান লোককে পাঠাতে হচ্ছে। এখন তোমার কিছু প্রশ্ন থাকলে বলো।’
রানা বলল, ‘গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি আমি, কিন্তু ঠিক কোন হোটেলে উঠতে হবে জানা নেই।
‘দাঁড়াও, তার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। ইন্টারকমের একটা বোতাম টিপে রাহাত খান বললেন, ‘শেখ, কোনও খবর পেলে? এ জী, স্যর। আমি আসছি এখুনি। ইন্টারকমের ভিতর দিয়ে চীফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটার কর্নেল শেখের গলাটা কেমন ধাতব খনখনে শোনাল।
লম্বা চেস্টারফিল্ডের প্যাকেট থেকে একটা চিপ্টে যাওয়া সিগারেট বের। করলেন রাহাত খান প্যাকেটের উপর টোকা দিয়ে দিয়ে। তারপর রনসন গ্যাস লাইটার দিয়ে ধরিয়ে নিলেন একটা দিক। রানারও হঠাৎ সিগারেটের তেষ্টা পেল খুব। এই ঘর থেকে বেরিয়েই একটা সিনিয়র সার্ভিস ধরিয়ে ফুসফুস ভর্তি করে ধোয়া নেবে ভাবতেই জিভে জল এসে গেল ওর। মনে হলো কত যুগ যেন সিগারেট খায়নি। কয়েক সেকেণ্ড ইন’ ট্রের কয়েকটা জরুরী কাগজে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিলেন রাহাত খান। তারপর রানার দিকে চেয়ে বললেন, ‘চিটাগাং-এর সব হোটেলেই টেলিফোন করা হয়েছে, দেখা যাক তোমার ভাগ্যে কোন হোটেল জুটল।
কর্নেল শেখ ঘরে ঢুকবার সময় রাহাত খানের কথার শেষটুকু শুনে রানার দিকে চেয়ে একটু হাসল। তারপর বলল, হোটেল মিসখা। চেনেন?
‘চিনি। স্টেশন রোডে, রেস্ট হাউসের ঠিক উল্টো দিকে, সিনেমা হলটার পাশে,’ বলল রানা।
‘হাঁ। মিসখার পাঁচতলায় দশ নম্বর এয়ার কণ্ডিশনড রুম বুক করা আছে। মিস্টার অ্যাণ্ড মিসেস মাসুদ রানা, থুড়ি, সুবীর সেনের নামে। রানার পাশে একটা চেয়ারে সশব্দে বসল প্রকাণ্ড দেহী কর্নেল শেখ। যেমন উচ্চতা তেমনি প্রস্থ। খাস মুলতানী। নিজ রসিকতায় নিজেই খুশি হয়ে হাততালি দিতে চায়।