দরজাটা খুট করে বন্ধ হতেই চোখ ফিরিয়ে একবার আপাদমস্তক দেখলেন রানাকে তারপর টেবিল থেকে পা নামিয়ে সোজা হয়ে বসলেন রাহাত খান। মাথাটা একটু ডান দিকে ঝাঁকিয়ে আবছা ইঙ্গিতে বসতে বললেন রানাকে।
এসব ইঙ্গিত রানার মুখস্থ-বিনা বাক্যব্যয়ে সামনের একটা চেয়ারে বসে পড়ল রানা। এবার তার আটান্নতম জন্মবার্ষিকীতে রানার উপহার দেয়া রনসন গ্যাস লাইটারের তলায় চাপা দেয়া একটা চারভাজ করা কাগজ তুলে নিয়ে রাহাত খান বললেন, ‘এটায় একবার চোখ বুলিয়ে পকেটে রেখে দাও। মজার জিনিস।
ভাঁজ খুলে দেখল রানা, ক্রীম কালারের অনিয়নষ্কিন পেপারে ইংরেজিতে টাইপ করা একটা চিঠি ওটা। এ-ফোর সাইজ অর্থাৎ ২১০x২৯৭ মিমি কাগজ। বেশ কিছুদূর গড়গড় করে পড়ে গেল ও, কিন্তু অর্থ কিছুই বুঝতে পারল না। সাঙ্কেতিক ভাষায় লেখা চিঠিটা। হঠাৎ চিঠিটার উপর দিকে ডান ধারে একটা বিশেষ চিহ্ন দেখেই রানা বুঝল এটা ইণ্ডিয়ান সিক্রেট সার্ভিসের চিঠি। এই চিহ্ন আগেও দেখেছে ও কয়েকবার।
মুখ তুলে রাহাত খানের দিকে চাইতে তিনি ইঙ্গিত করলেন ওটা পকেটে রেখে দেবার জন্যে। বেশি কথা বলা পছন্দ করেন না তিনি, তাই যতটা সম্ভব আকারে-ইঙ্গিতেই কাজ সারেন।
এবার আর একটা কাগজ টেবিলের উপর রানার দিকে একটু ঠেলে দিলেন তিনি। বললেন, ‘ওই চিঠির অনুবাদ। মন দিয়ে পড়ো। কোথাও বুঝতে না পারলে জিজ্ঞেস করবে।’
রানা একবার খান সাহেবের মুখের দিকে চাইল। কিছুই আন্দাজ করা গেল। না, সে মুখ দেখে না। গোফ দাড়ি পরিষ্কার করে কামানো। কপালে আর গালে বয়সের ভাজ পড়েছে কয়েকটা। কাঁচা পাকা ভুরু। এ ছাড়া ঋজু দেহটায় প্রৌঢ়ত্বের আর কোনও চিহ্ন নেই। ইজিপশিয়ান কটনের ‘ধবধবে সাদা স্টিফ কলার শার্ট, সার্জের সুট আর ব্রিটিশ কায়দায় বাধা দামি টাইয়ের নট-সবটা মিলিয়ে খুব সপ্রতিভ চেহারা বুড়োর। তীব্র চোখ দুটো এখন নিরাসক্তভাবে চেয়ে আছে সামনের দেয়ালে টাঙানো অ্যাংলো-সুইস ইলেকট্রনিক ঘড়িটার দিকে।
একটু ঝুঁকে চিঠিটা তুলে নিল রানা টেবিলের উপর থেকে। ইংরেজিতে লেখা।
সে চিঠির বাংলা করলে দাঁড়ায়:
মঙ্গলবার
এল’ সেন্টারে তোমার কাজ প্রশংসা অর্জন করেছে। নতুন কাজের ভার দেয়া হচ্ছে। তোমার ফোক্সভাগেন নিয়ে আগামীকাল, বুধবার ঠিক এগারোটায় ডি-সি ফেরি পার হও। ১৬৫ মাইল পথ, গড়পরতা ৪০ মাইল বেগে চলবে। বেলা তিনটা পঁয়তাল্লিশে চারজন ইপিআর সৈন্য তোমার গাড়ি থামিয়ে চারটে প্যাকেট তুলে দেবে গাড়ির সামনের বুটে। সেই সঙ্গে গাড়িতে উঠবে একজন মহিলা। স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে দশ নম্বর রুম বুক করা আছে তোমাদের জন্য নির্দিষ্ট হোটেলে। সেখানে লাগেজ উঠিয়ে প্যাকেটসুদ্ধ গাড়িটা মেয়েটির হাতে ছেড়ে দিয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য অপেক্ষা করবে হোটেলেই।
দুবার আগাগোড়া চিঠিটা পড়ে মুখ তুলল মাসুদ রানা। দেখল দুটো চোখ গভীর মনোযোগের সঙ্গে তাকে পরীক্ষা করছে।
কী বুঝলে?’ প্রশ্ন করলেন রাহাত খান।
‘সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার, স্যর! ভারতীয় কোনও গুপ্তচরকে গাড়ি চালিয়ে ঢাকা থেকে চিটাগাং যাবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে আজই এগারোটার সময়। চট করে। রিস্টওয়াচটা দেখে নিয়ে আবার রানা বলল, ‘সুপরিকল্পিত কোনও প্ল্যান বলেই মনে হচ্ছে। পৌনে চারটেয় কুমিল্লা ছাড়িয়ে চোদ্দগ্রামের কাছাকাছি বর্ডারের পাশ দিয়ে গাড়ি যাবে, তখন ইপিআর-এর ছদ্মবেশে কয়েকজন ভারতীয় সেনা গাড়িতে কিছু মাল তুলে দেবে। চিটাগাং-এ কোনও সাঙ্ঘাতিক ঘটনা ঘটতে চলেছে, স্যর। নিরাপত্তার জন্যে কাজটা দুভাগে ভাগ করে দেয়া হয়েছে-ছেলেটার কিছুটা, মেয়েটার কিছুটা।’
রানার মধ্যে এই হঠাৎ উত্তেজনার সঞ্চার দেখে একটু হাসলেন মেজর জেনারেল রাহাত খান। বললেন, ঠিক ধরেছ। এখন শোনো। এই সাঙ্কেতিক চিঠিটা নিতান্ত ভাগ্যক্রমে পাওয়া গেছে ভারতের এক নামকরা গুপ্তচর সুবীর সেনের পকেটে। গতরাতে আড়াইটার দিকে শাহবাগ হোটেল থেকে ঠোঁটে গালে লিপস্টিকের দাগ নিয়ে মাতাল অবস্থায় ফিরছিল সে গাড়ি চালিয়ে। ঢাকা ক্লাবের সামনে একটা শালগাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে চুরমার হয়ে গেছে সে গাড়ি।
রানার মনে পড়ে গেল, গত রাতে ক্লাব থেকে ক্লডিনকে নিয়ে ফেরার পথে একটা সাদা ফোক্সভাগেনকে প্রায় চুরমার অবস্থায় দেখেছে ও ঢাকা ক্লাবের সামনে। বলে ফেলল, ‘গাড়িটা আমি দেখেছি, স্যর।
ভুরু কুঁচকে তিরস্কারের ভঙ্গিতে তার দিকে চেয়ে রাহাত খান বললেন, ‘ভোর সোয়া-পাঁচটায় মিলিটারি ক্রেন এসে উঠিয়ে নিয়ে গেছে সে গাড়ি। রাত আড়াইটা থেকে ভোর সোয়া পাঁচটা-এর মধ্যে তুমি দেখলে কী করে সে গাড়ি? লম্পট সুবীর সেনের মত তুমিও নিশ্চয়ই ফিরছিলে কোনওখান থেকে, রানা?
চুপ করে থাকল রানা। গতরাতের অনাচারের কথা কঠোর নীতিপরায়ণ সত্যনিষ্ঠ রাহাত খানের কাছে আর গোপন থাকল না!
নিজেকে শুধু শুধু অপচয় কোরো না, রানা। রানার অপরাধী মুখের দিকে চেয়ে বললেন খান। দুই সেকেণ্ড চুপ করে থেকে আবার বললেন, ‘যাক, যা বলছিলাম, চিঠিটা সে পেয়েছে খুব সম্ভব পাক এয়ারলাইনসের কোনও এয়ার হোস্টেসের কাছ থেকে। কাল সন্ধ্যার ফ্লাইটে এই দু’মুখো সাপ (যে সমস্ত পাকিস্তানী মুসলমান ভারতের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করে তাদেরকে খান সাহেব ঘৃণা ভরে দু’মুখো সাপ বলেন) কলকাতা থেকে এ চিঠি নিয়ে এসেছে এবং রাতে সেনকে এ চিঠি আর প্রচুর চুম্বন উপহার দিয়েছে।