মতিঝিল কমার্শিয়াল এরিয়ার একটা সাততলা বাড়ির পিছন দিকটায় গাড়ি পাক যমে লিফটের বোতাম টিপল মাসুদ রানা। ওকে দেখে লিফটম্যান কোনও প্রশ্ন না করেই ফিফথ ফ্লোর, অর্থাৎ ছতলায় উঠে এল। ছয় এবং সাততলার সবটা জুড়ে পিসিআই বা পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের অফিস। নিচেরতলাগুলো হরেক রকম ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টুকরো টুকরো করে ভাড়া নিয়ে দফতর খুলেছে।
ছ’তলার বেশির ভাগটাই জুড়ে রয়েছে রেকর্ড সেকশনের ব্যস্ত-সমস্ত কেরানির দল, জনা পনেরো মেয়ে-পুরুষ টাইপিস্ট, স্টেনো ইত্যাদিতে। কেবল ডানধারের সব শেষে করিডোরের দুপাশে মুখোমুখি চারটে কামরায় বসে রানা আর তার তিন সহকর্মী।
সাততলায় মেজর জেনারেল রাহাত খান আর চীফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর কর্নেল শেখের কামরা। আর বাকিটায় অত্যাধুনিক সরঞ্জামে সুসজ্জিত ওয়্যারলেস সেকশন। সাড়ে তিন শ’ কিলোওয়াটের অত্যন্ত শক্তিশালী ট্রান্সমিটার রয়েছে। ছাতে। বিদঘুঁটে সব যন্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে কাজ করছে স্পেশাল ট্রেনিং প্রাপ্ত জনাকয়েক অপারেটর, কানে হেডফোন। মাইেক্রোওয়েভ, সানস্পট আর হেভি সাইড লেয়ারের জগতে আছে এরা। পাশের টেবিলে রাখা শর্টহ্যাণ্ড খাতা। ২
সব মিলিয়ে নিখুঁত এ প্রতিষ্ঠানটি। কোনও গোলমাল নেই; যেন আপনাআপনি সব কাজ হয়ে যাচ্ছে, এমন শৃঙ্খলা।
মাসুদ রানা প্রথমেই ঢুকল নিজের কামরায়। ঘরটার চারভাগের একভাগ কার্ড বোর্ডের পার্টিশন দিয়ে আলাদা করা। সেখানে টাইপিস্ট মকবুল বসে রানার গত কেসটার পূর্ণ বিবরণ টাইপ করছে। রানাকে দেখে পিঠটা কুঁজো করে উঠে দাঁড়াল। মকবুল। বোসো,’ বলে সুইংডোরটা ঠেলে নিজের ঘরে ঢুকল রানা।
ইন লেখা বেতের কারুকাজ করা ট্রে-তে গোটা কয়েক ফাইল জমা হয়ে। আছে। ওগুলোর দিকে অনুকম্পার দৃষ্টিতে চেয়ে একটু হাসল রানা। ভাবল আজ বাছাধনেরা একটু বিশ্রাম নাও, আজ আর তোমাদের কাছে ভিড়ছি না।
টেবিলের উপর হাতের ডানধারে রাখা ইণ্টারকমের একটা বোতাম টিপে রানা বলল, মাসুদ রানা বলছি, আমাকে ডেকেছিলেন, স্যর?
গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর এল, ওপরে এসো।’
বুকের মধ্যে ছলাৎ করে উঠল খানিকটা রক্ত। কেমন একটা আনন্দ শিহরনের মত অনুভব করল রানা এক সেকেণ্ডের জন্য। মাসখানেক পর আজ আবার গিয়ে। দাঁড়াবে সেই তীক্ষ্ণ দুটি চোখের সামনে-যে চোখের অধিকারীকে আজ সাত বছর ধরে ও ভক্তি করেছে আর ভালবেসেছে। ওই ক্ষুরধার দৃষ্টির ইঙ্গিতে কতবার কত ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ও বিনা দ্বিধায়।
লিফটের দিকে না গিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোল রানা। সুন্দরী রিসেপশনিস্ট রানাকে দেখে মিষ্টি করে হাসল। রানাও একটু হেসে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে। উপরে উঠে গেল।
ডানধারে সবশেষের ঘরটায় বসেন রিটায়ার্ড মেজর জেনারেল রাহাত খান। বাঙালীদের মধ্যে তিনিই প্রথম ব্রিটিশ আর্মি ইন্টেলিজেন্সের এত উপরে উঠতে পেরেছিলেন। ১৯৫২ সালে শিশু রাষ্ট্র পাকিস্তান যখন বহির্বিশ্বের ক্রমবর্ধমান কুচক্রের বিরুদ্ধে অত্যন্ত শক্তিশালী কোনও প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে উপলব্ধি করছে, ঠিক সেই সময় অবসর গ্রহণ করলেন আর্মি ইন্টেলিজেন্সের প্রতিভাবান মেজর জেনারেল রাহাত খান। সঙ্গে সঙ্গেই নতুন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা হলো, নাম দেওয়া হলো পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স-এবং দ্বিধামাত্র না করে কর্ণধার হিসাবে রাহাত খানকে বসিয়ে দেয়া হলো এর মাথায়। অনেক বাক-বিতণ্ডার পর ঢাকায় এর হেড-কোয়ার্টার স্থাপনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্তভাবে গৃহীত হলো।
নিজহাতে এ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন রাহাত খান মনের মত করে। অক্লান্ত পরিশ্রম করে কয়েক বছরের মধ্যে এত বেশি সুনাম অর্জন করেছে এ প্রতিষ্ঠান যে আমেরিকা, বৃটেন আর সোভিয়েট ইউনিয়নের গুপ্তচর বিভাগ এখন পিসিআইকে নিজেদের সমকক্ষ বলে স্বীকার করতে গর্ব অনুভব করে।
কিছুটা গোপনীয়তার খাতিরে আর কিছুটা পাকিস্তানের বাইরে পৃথিবীর প্রায়। সর্বত্র কার্যরত পিসিআই এজেন্টদের গতিবিধির এবং জরুরী খবর আদান-প্রদানের সুবিধার জন্য বাড়িটা ভাড়া নেয়া হয়েছে একটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ছদ্মনামে। মস্ত বড় এক সাইন বোর্ড টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে, তাতে ইংরেজিতে লেখা:
ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং করপোরেশন,
এক্সপোর্টার্স-ইমপোর্টার্স-ইনডেনটার্স।
ব্যবসার খাতিরে বা চাকরির খোঁজে কেউ যদি ভুল করে এখানে এসে ওঠে, তবে রিসিপশনিস্টের মিষ্টি হাসি এবং কয়েকটা প্রশ্নের না-বাচক উত্তর নিয়েই তাকে সন্তুষ্ট চিত্তে ফিরতে হয়।
‘আসুন, স্যর। বড় সাহেব আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।’ বলল গোলাম সারওয়ার। টেলিফোন করবার ঠিক চার মিনিটের মধ্যে রানাকে সশরীরে উপস্থিত দেখে একটু বিস্মিতই হলো সে। তারপর আবার আপন কাজে মগ্ন হয়ে গেল।
আস্তে টোকা দিয়ে দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করল রানা। পুরু কার্পেটে আগাগোড়া মোড়া মস্ত ঘরটা। উত্তর দিকের জানালার দামি কার্টেনটা একপাশে সরানো। পুরু বেলজিয়াম কাঁচে ঢাকা মস্ত সেক্রেটারিয়েট টেবিলের উপর পা তুলে দিয়ে রিভলভিং চেয়ারে আরাম করে বসে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে কী যেন ভাবছেন রাহাত খান। আঙুলের ফাঁকে কিং সাইজের একটা জ্বলন্ত চেস্টারফিল্ড সিগারেট। আমেরিকান টোস্টেড টোবাকোর গন্ধ সারা ঘরে।