‘জানি।’ কথাটার মধ্যে আত্মপ্রত্যয় আছে।
আগে কোথায় কাজ করেছ?
‘ওমা! নোকের বাসায় কাজ করতি যাব কেন? আমার নিজিরই…’ হঠাৎ চেপে গেল বুড়ি। তারপর একটু মলিন হাসি হেসে বলল, ‘বিটার বউয়ের সাথি নাগ করে আসছি।
বাড়ি কোথায় তোমার?
যশোহর।
‘ছেলে-বউ কোথায়?
‘সিখানেই।
‘ও, পালিয়ে এসেছ ঢাকায়? দুদিন পর আবার মন টানলেই এখান থেকে পালাবে। যাও তুমি, এমন লোক আমার লাগবে না।
এই উত্তরই যেন আশা করেছিল ঠিক এমন ভাবে কোনও রকম যুক্তিতর্কের অবতারণা না করেই চলে যাচ্ছিল বুড়ি। হঠাৎ রানা কী ভেবে ডাকল পিছন থেকে। বুড়ি ঘুরতেই রানা দেখল জল গড়াচ্ছে ওর চোখ দিয়ে। বুঝল রানা, এক কাপড়ে রাগের মাথায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে–ঢাকায় কোথাও কিছু চেনে।
এ বাড়ি ও বাড়ি ঠোকর খেয়ে ফিরছে, কিন্তু চাকরি হয়নি। খাওয়া-দাওয়া হয়নি কদিন কে জানে। এমন অপ্রত্যাশিত দুর্বিপাকে পড়ে রাগে দুঃখে হতাশায় ভেঙে পড়েছে বুড়ি। আঁচল দিয়ে চোখ মুছে কাছে এসে দাঁড়াতেই রানা বলল, তা বেতন চাও কত?
‘আমি তো জানিনে, কাজের নোককে সবাই যা দেয় তাই দেবেন।
‘বেশ। থাকো আমার এখানেই। মোখলেস তো ওর হাঁড়ি পাতিল ধরতে দেবে না। তুমি এখন খেয়েদেয়ে বিশ্রাম করো, বিকেলে ওর সঙ্গে গিয়ে দোকান থেকে সব কিনে আনবে।’
সেই বুড়ি রয়েই গেল। ঝোঁকের মাথায় ওকে থাকতে বলেই খুব আফসোস হয়েছিল রানার-কেন শুধু শুধু জঞ্জাল বাড়াতে গেলাম! বেশ তো চলছিল, কোনও হাঙ্গামা ছিল না। ভেবেছিল–কোনও ছুতো পেলেই বাড়ি পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু
পরদিন ওর হাতের বাঙালী রান্না খেয়ে পরিতৃপ্তির একটা ঢেকুর তুলে সিদ্ধান্ত নিল। রানা-ছলে বলে কৌশলে যেমন করে হোক একে রাখতেই হবে, ছাড়া যাবে না।
এখন অবশ্য বাজার করা ছাড়া মোখলেসের অন্য কাজ নেই-অল্পদিনেই বুড়ি বিলিতি রান্নাতেও ওকে ছাড়িয়ে গেছে, আর মোখলেসও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে।
.
টেলিফোনটা বেজে উঠল।
‘হ্যালো, ফাইভ-এইট-টু-সেভেন, রানা ধরল।
‘কে, মাসুদ সাহেব বলছেন?’ প্রশ্ন এল অপর দিক থেকে।
হ্যাঁ। কী খবর, সারওয়ার?
‘এক্ষুণি আপনাকে একটু অফিসে আসতে হবে, স্যর। বড় সাহেব খুব জরুরী তলব করেছেন আপনাকে। মেজর জেনারেল রাহাত খানের পিএ, গোলাম সারওয়ার বলল নির্বিকার কণ্ঠে।
বিশেষ করে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনও বিষয় উপস্থিত হলে চেহারা-চালচলনে চেষ্টাকৃত ভাবে একটা নির্লিপ্ত ভাব এনে এক ধরনের আনন্দ পায় গোলাম সারওয়ার। বোধহয় আত্মসংযমের আনন্দ। রানার খুব ভাল করে জানা আছে এ কণ্ঠস্বর। তাই জিজ্ঞেস করল, ব্যাপার কী বল তো, সারওয়ার! নতুন গোলমাল। বাধল কিছু?
‘কোথায় আছেন, স্যর! হুলুস্থুল কারবার। ভোর পাঁচটা থেকে অফিস করছি আজ। জলদি চলে আসেন।’ বলেই ফোন ছেড়ে দিল কাজের চাপে সর্বক্ষণ ব্যস্ত অক্লান্ত পরিশ্রমী গোলাম সারওয়ার অন্য কোনও প্রশ্নের সুযোগ না দিয়েই।
মাসুদ রানা চোখ বন্ধ করে স্পষ্ট দেখতে পেল টেলিফোনটা রেখেই চটপট গোটা কতক ইমিডিয়েট লেবেল লাগানো ফাইল নিয়ে গোলাম সারওয়ার ছুটল চীফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের কামরার দিকে।
ঘন কালো ভুরু জোড়া অল্প একটু উঁচু করে ছোট্ট একটা শিস দিল মাসুদ রানা। তারপর দ্বিতীয় সিগারেটের অর্ধেক থাকতেই অ্যাশট্রেতে ঠেসে মুচড়ে আগুনটা নিভিয়ে উঠে দাঁড়াল।
প্যান্ট আর জুতো পরাই ছিল-ভোরবেলা গোসল সেরেই এগুলো পরে ফেলে। ও সব সময়। ড্রয়ার থেকে পিস্তল ভরা হোলস্টারটা বের করে বাঁ কাঁধে ঝুলিয়ে নিল রানা। পিস্তলটা খুব দ্রুত কয়েকবার হোলস্টার থেকে বের করে ঠিক জায়গা মত হাতটা পড়ছে কি না দেখে নিল। তারপর রোজকার অভ্যাস মত স্লাইডটা। আটবার টেনে একে একে আটটা গুলি বের করে পরীক্ষা করল ইজেক্টার ক্লিপটা ঠিকমত কাজ করছে কি না। ম্যাগাজিন রিলিজটা টিপতেই সড়াৎ করে বেরিয়ে এল খালি ম্যাগাজিন। স্লাইড টেনে ধরে চেম্বারে একটা বুলেট ঢুকিয়ে আস্তে হ্যাঁমারটা নামিয়ে দিল রানা। ঠিক ফায়ারিং পজিশনে এনে রাখে ও সব সময় তার বিপদসঙ্কুল রোমাঞ্চকর জীবনের একমাত্র বিশ্বস্ত সাথী এই পয়েন্ট থ্রি-টু ক্যালিবারের ডাবল অ্যাকশন অটোমেটিক ওয়ালথার পিপিকে পিস্তলটি। ম্যাগাজিনে সাতটা বুলেট ভরে যথাস্থানে ঢুকিয়ে দিল রানা। ক্যাচের সঙ্গে আটকে একটা ক্লিক শব্দ হতেই সন্তুষ্ট চিত্তে আবার শোল্ডার হোলস্টারে ভরে রাখল ও তার ছোট্ট যন্ত্রটা। তারপর একটা নীল টি-শার্ট পরে টেবিলের লম্বা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরে ফিরে ভাল করে দেখে নিল শোল্ডার হোলস্টারটা কোনও দিক থেকে দেখা যাচ্ছে কি না। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে ওর একান্ত প্রিয় জাগুয়ার এক্স কেই গাড়িতে স্টার্ট দিল।
‘ও আব্বা, দরোজার চাবিটা নেছেন?’ রাঙার মা এসে দাঁড়াল।
‘না, তো কেন? তুমি বাসায় থাকবে না?
‘দোফরে একটু মিরপুরের মাজার যাব।’
ড্রয়ার থেকে আমার চাবিটা নিয়ে মোখলেসের কাছে দিয়ে যেয়ো।
‘ও-ও ত আমার সঙ্গে যাবি।
‘বেশ, তোমার চাবিটা জলদি আমাকে দাও-তুমি ড্রয়ার থেকে আমারটা নিয়ে নিয়ো। নাও, তাড়াতাড়ি করো।’
বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটু হাসল রানা। যেদিনই অফিস থেকে ওর বিশেষ টেলিফোন আসবে, সেদিনই বুড়ির মিরপুরের মাজারে যাওয়া চাই। এই দুই বছরের মধ্যে রাঙার মা দেখেছে, যতবারই এমন টেলিফোন এসেছে ততবারই আব্বা কয়দিন আর বাড়িতে ফেরেনি। প্রায়ই শরীরে কাটাকুটি নিয়ে বাড়ি ফেরে। আব্বা। একবার তো বিশদিন পর খাঁটিয়ায় করে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে দিয়ে, গেল কয়েকজন লোক-সারা অঙ্গে জখমের দাগ। একমাস কত সেবা শুশ্রূষা করে। জ্যান্ত করতে হয়েছে তাকে। আব্বা যে কী কাজ করে তা ঠিক জানে না সে, তবে কাজটা যে খুবই ভয়ঙ্কর এবং বিপজ্জনক তা সে বুঝতে পারে। সদাসর্বদা তাই শঙ্কিত হয়ে থাকে সে। একেক বার মনে হয় আব্বা বোধহয় পুলিশের নোক; আবার সন্দেহ হয়, পুলিশের নোক যদি হয় তবে মেজাজ এত ঠাণ্ডা কেন? গোলাগুলির সঙ্গে কারবার আব্বার-তাই তো আব্বার সঙ্গে সব সময় ছোট-বন্দুক থাকে। এইটাই আব্বার চাকরি, বিপদ আছে বলেই না মাসে মাসে ষোল শ’ টাকা। করে মাইনে দেয় আব্বাকে। কোনও ভাবে বারণ করতে পারে না সে, তাই যতবারই রানা কোনও কাজে হাত দেয়, ততবারই রাঙার মা মিরপুরের মাজারে গিয়ে মানত করে আসে। যখন সুস্থ বা অসুস্থ অবস্থায় সে ফিরে আসে, তখন। মোখলেসকে দিয়ে মানত পুরো করে দেয়। বিরক্ত হয়ে মোখলেস একদিন রাঙার মার এসব গোপন কথা বলে দিয়েছে রানাকে।