‘এত নীচ থেকে ওপরে উঠবে কী করে আমাকে নিয়ে? আমাকে না হয়। এখানে ছেড়ে দিয়ে তুমি চলে যাও।
বাজে কথা বোলো না, লতা। তোমাকে ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে আমি নিজের প্রাণ বাঁচাতে চাই না। তার চেয়ে এসো দুজন একসঙ্গে চেষ্টা করি-মরি যদি, দুজন একসঙ্গে মরব।’
অদ্ভুত সাহস তোমার, রানা!’
‘বিয়ের রাতে বাসরঘরে আমার অনেক প্রশংসা কোরো-এখন তোমার শাড়ি খানিকটা ছিঁড়ে চারটে ছোট ছোট টুকরো কর তো। ওগুলো কানের মধ্যে গুঁজে না নিলে এত গভীর পানিতে চাপ লেগে কানের পর্দা ফেটে যেতে পারে।’
নতুন শাড়িটা ছিঁড়তে এক মুহূর্ত একটু দ্বিধা করল সুলতা। হাজার হোক মেয়ে তো! তারপরই রানার কথা মত কাজ করল।
রানা বলল, ‘রেডি?
মাথা ঝাঁকাল সুলতা।
.
এক হাতে সুলতাকে জড়িয়ে ধরে আরেক হাতে সাঁতার কাটছে রানা উপরে উঠবার জন্য। পা দুটো ঠিকমত ব্যবহার করতে পারছে না-বেধে যাচ্ছে সুলতার শাড়িতে, উরুতে।
শেষের তিরিশ ফুট মনে হলো যেন আর শেষ হবে না। একে নির্যাতনে দুর্বল শরীর, তার উপর এই অমানুষিক পরিশ্রম-বুকের ছাতি ফেটে যেতে চাইছে। রানার। কপালের দুই পাশে দুটো শিরা দপ দপ করছে। প্রাণপণে সাঁতরে চলল রানা। নিজের কষ্ট ভুলে ভাববার চেষ্টা করল সুলতার না জানি কত কষ্ট হচ্ছে।
কিন্তু এই ওপরে ওঠার কি শেষ নেই? ফুট দশেক থাকতেই হাল ছেড়ে দিল রানা। আর পারা যায় না। ধীরে ধীরে নামতে আরম্ভ করল আবার ওরা। এভাবে নামতে ভালই লাগছিল রানার। ঘাড়ে, গলায়, কানের পাশে সুড়সুড়ি লাগছে পানি। লেগে। হঠাৎ সুলতা একটু নড়ে উঠতেই হুশ হলো রানার। শেষ চেষ্টা করে দেখবে ও একবার। বুকের ভিতর হাতুড়ি পিটছে হৃৎপিণ্ড। আবার উঠতে থাকল ওরা ওপরে। ইয়াকুবের মুখটা একবার ভেসে উঠল রানার মনের পর্দায় কেন জানি।
ওপরে উঠে নাক-মুখ দিয়ে অনেক পানি বেরোল সুলতার। দুজনেই খানিকক্ষণ হাঁ করে মুখ দিয়ে শ্বাস নিল বুক ভরে।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। গোধূলির সব রঙ মুছে গেছে মেঘের ফালি থেকে। আবছা চাঁদের আলোয় পনেরো গজ দূরে পাহাড়ের ছোট্ট মাথাটা দেখে যেন জ্ঞান ফিরে পেল রানা। পালাতে হবে। এই অভিশপ্ত পাহাড়ের কাছ থেকে পালাতে হবে দূরে। মনে পড়ে গেল গতরাতের অভিযানের কথা, আবদুলের কথা। এখনও ‘ডেকা’ রাডার স্ক্যানার ঘুরছে টিলাটার চূড়ায়।
সুলতার মাথা পানি থেকে অল্প একটু ভাসিয়ে রেখে এক হাতে ব্যাকস্ট্রোক দিয়ে পিছনে সরে যেতে শুরু করল রানা।
হঠাৎ পাহাড়ের মাথায় কবীর চৌধুরীর প্রকাণ্ড দেহটা দেখে চমকে উঠল রানা। কবীর চৌধুরীও দেখল ওদের। তারপর ঝপাং করে লাফিয়ে পড়ল পানিতে। দ্রুত এগিয়ে আসছে চৌধুরী ওদের দিকে।
এইবার প্রমাদ গুণল রানা। একটা মাত্র গুলি আছে ওর রিভলভারে। কবীর চৌধুরীর তা অজানা নেই। যদি এক গুলিতে ওকে ঘায়েল করা না যায় তবে ওর হাতে নিশ্চিত মৃত্যু হবে দুজনের। কাজেই আগে গুলি ছুড়বে না বলে স্থির করল রানা। কবীর চৌধুরীর মনে গুলি খাওয়ার ভয় থাকুক কিছুটা।
কিন্তু চৌধুরী নিজে আসছে কেন তোক না পাঠিয়ে? ও নিশ্চয়ই টের পেয়েছে সোডিয়ামের ড্রাম ফুটো হবার কথা। তাই কাউকে কিছু না বলে সরে আসছে পাহাড় থেকে। সেই সঙ্গে ওর সবকিছু ধ্বংস করে দেয়ার প্রতিশোধটাও তুলে নেবে।
প্রাণপণে ব্যাকস্ট্রোক দিয়ে চলল রানা-সেই সঙ্গে পা দুটো চলছে প্রপেলারের মত। কিন্তু এক হাতে কত আর সাঁতরাবে সে? তার উপর সুলতার ভার। এখন মনে হলো আরও একটা গুলি অন্তত হাতে রাখা উচিত ছিল।
ধীরে ধীরে দূরত্ব কমে আসছে ওদের। পনেরো গজ দূরে থাকতেই প্রথম গুলি করল কবীর চৌধুরী। রানা অনুভব করল ওর হাতের মধ্যে হঠাৎ সুলতার দেহটা একবার অস্বাভাবিকভাবে চমকে উঠল। পরক্ষণেই রানার চোখে-মুখে কী যেন ছিটে এসে পড়ল। চোখে দেখতে পাচ্ছে না রানা আর। তাড়াতাড়ি পানি দিয়ে পরিষ্কার করে নিল ও চোখ-মুখ। হাতে লাগল চটচটে কী যেন।
হঠাৎ কী মনে হতেই আঁতকে উঠে সুলতার মুখের দিকে চাইল রানা। দেখল মাথাটা হেলে পড়েছে এক দিকে। হ্যাঁ! অব্যর্থ চৌধুরীর হাতের টিপ। তাজা রক্ত আর মগজের অংশ ছিটকে বেরিয়ে এসে লেগেছিল রানার চোখে-মুখে।
রিভলভার বের করল রানা। কিন্তু সামনে কী যেন দেখে এগোনো বন্ধ করে দিয়েছে কবীর চৌধুরী। রানা গুলি করবার আগেই ডুব দিল পানির মধ্যে।
প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে গিয়ে উঠল কবীর চৌধুরী। গুলি করল রানা। দূর থেকে একটা অট্টহাসির শব্দ ভেসে এল। চলে গেল কবীর চৌধুরী।
সামনে যতদূর দেখা যায় কেবল জল আর জল। মেঘবিহীন বৈশাখের আকাশে নিঃসঙ্গ পূর্ণিমার চাঁদ। ছোট ছোট ঢেউয়ের মাথায় আলোর মুকুট। ফুর ফুর করে বইছে পুবালী হাওয়া। মাথার উপর দিয়ে বাদুড় উড়ে গেল একটা।
চাঁদের আলোয় নিষ্প্রাণ সুলতার মলিন মুখটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। রানা। ছোট্ট একটা চুম্বন এঁকে দিল ওর কপালে। তারপর ছেড়ে দিল পানির ভেতর। দ্রুত নেমে গেল দেহটা নীচে। সুলতার চিহ্নও থাকল না আর। নিজেকে বড় নিঃসঙ্গ, একা মনে হলো রানার। হু হু করে উঠল বুকের ভিতরটা এক অবর্ণনীয় বেদনায়। অবসন্ন দেহটাকে ভাসিয়ে রাখতে কষ্ট হচ্ছে খুব।
কিন্তু কীসের এক মোহে ওখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাঁতার কাটতে থাকল। রানা-জায়গাটা ছেড়ে কিছুতেই চলে যেতে পারছে না ও।