‘তুমি! কী করে ছাড়া পেলে, রানা!’
সব বলব পরে। এখন উঠে পড়ো, লক্ষ্মী। একটুও সময় নেই-দেরি করলেই আবার ধরা পড়তে হবে।’
ছুটল দুজন লিফটের দিকে। উপরের দিকে না গিয়ে দুই নম্বর বোতাম টিপল রানা। লিফট থেকে নামতেই কবীর চৌধুরীর গলা শুনতে পেল লাউড-স্পীকারে। সমস্ত পাহাড়ের লোককে নির্দেশ দিচ্ছে সে।
‘দোতলায় ছোটো সবাই। ওরা ওপর দিকে যায়নি। দোতলায় সোডিয়ামের ঘরের দিকে যাচ্ছে এখন। যে যেখানে আছ দোতলায় যাও। যার সামনে পড়বে সে-ই গুলি করবে। ইনফ্রা-রেড রে-র সাহায্যে রানার গতিবিধি টের পাচ্ছে। চৌধুরী পরিষ্কার।
মস্ত বড় বড় টিনের ড্রামের মধ্যে সোডিয়াম রাখা। আকারে একেকটা আলকাতরার ড্রামের তিনগুণ হবে। পাশাপাশি আটটা ড্রামের পেট বরাবর গুলি। করল রানা। ড্রাম ফুটো হয়ে গিয়ে কলের জলের মত কেরোসিন তেল বেরিয়ে। মেঝেতে পড়তে আরম্ভ করল। রানা জানে অক্সিজেন থেকে বাঁচবার জন্য কেরোসিন তেলের মধ্যে চুবিয়ে রাখা হয় সোডিয়াম। এই তেল বেরিয়ে গেলেই অক্সিজেনের সংস্পর্শে এসে গরম হয়ে উঠবে সোডিয়াম-তারপরই ঘটবে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ। তার আগেই আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে এখান থেকে যে করে হোক, ভাবল রানা।
কিন্তু বেরোবে কোনদিক দিয়ে? পাহাড়ের উপর দিকটা এতক্ষণে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত করে ফেলেছে কবীর চৌধুরী। উপরে উঠতে গেলেই গুলি খেয়ে মরতে হবে। তা হলে? এখন এগোবেই বা কোনদিকে?
চারদিক থেকে লোকজনের হৈ-হল্লা আর পায়ের শব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। একটা রিভলভার ফেলে দিল রানা। গুলি শেষ। এখন অবশিষ্ট রিভলভারের তিনটে গুলিই সম্বল।
সুলতার একটা হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল রানা ডান দিকে সেই তেল চুপচুপে মেঝের উপর দিয়ে। কিছুদূর গিয়েই মোড় ঘুরেছে রাস্তাটা। সেখানটায়। এসেই রানা দেখল তিন চারজন লোক এগিয়ে আসছে হন্তদন্ত হয়ে। এত কাছে জলজ্যান্ত ওদের দুজনকে সামনে দেখে একটু হকচকিয়ে গেল লোকগুলো। পর। পর দুটো গুলি করে দুজনকে ধরাশায়ী করল রানা। আর বাকি দুজন তীরবেগে ছুট দিল উল্টো দিকে জান-প্রাণ নিয়ে। পিছন থেকে বহু লোকের হৈ-হল্লা এগিয়ে আসছে দ্রুত। সেই সঙ্গে খুব কাছ থেকে লাউড-স্পিকারে কবীর চৌধুরী বলছে, মাসুদ রানা এখন একতলার সিঁড়ির কাছে। আর মাত্র একটা গুলি আছে ওর রিভলভারে। এগিয়ে যাও।
কয়েক পা গিয়ে সত্যিই সিঁড়ি পাওয়া গেল। তরতর করে নেমে এল ওরা একতলায়। এখন? এক দিকে গজ বিশেক গিয়ে শেষ হয়েছে করিডোর। সেই দিকেই দৌড় দিল রানা পাগলের মত।
হাঁফাতে হাঁফাতে সুলতা বলল, হাতটা একটু ছাড়ো। খুব লাগছে।’
চট করে হাত ছেড়ে দিল রানা। উত্তেজনার বশে সুলতার কব্জিটা প্রায় গুড়ো করে দেবার জোগাড় করেছিল ও জোরে চেপে ধরে।
এক সঙ্গে কয়েকটা পিস্তল,গর্জে উঠল। দেয়ালের সঙ্গে সেঁটে দাঁড়িয়ে রানা। দেখল প্রায় পঁচিশ-তিরিশজন লোক এগিয়ে আসছে। লাউড-স্পীকারে কবীর চৌধুরী বলল, এবারে মাথার ওপরে হাত তুলে দাঁড়াও, মাসুদ রানা। বাধা দিয়ে আর লাভ নেই।’
দেয়ালের গায়ে হাতড়ে যে বোতাম খুঁজছিল রানা পেয়ে গেল সেটা। টিপতেই সরে গেল দেয়ালটা একপাশে। সুলতাকে ধাক্কা দিয়ে ঘরের মধ্যে ঠেলে দিয়ে নিজেও ঢুকে পড়ল ভিতরে। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল আবার।
‘আমাদের বোধহয় ওপর দিকে যাওয়া উচিত ছিল,’ বলল সুলতা।
তখন আর কথা বলবার বা কারণ ব্যাখ্যা করবার সময় নেই। ছুটে গেল রানা ঘরের অপর দেয়ালের কাছে। টিম টিম করে একটা বাতি জ্বলছে ঘরে। উজ্জ্বল হয়ে উঠল রানার মুখ। যা ভেবেছিল ঠিক তাই। হাত দিয়ে দেখল একটা দেয়াল ভেজা।
‘শিগগির আমার কাছে এসো, লতা। খুব কষে আমাকে জড়িয়ে ধরো। জলদি। সময় নেই।’
দেয়ালের সঙ্গে লাগানো একটা লোহার কড়া এক হাতে শক্ত করে ধরল রানা। দেখল ওর গায়ের সঙ্গে সেঁটে থাকা সুলতার দেহটা থর থর করে কাঁপছে ভয়ে। তারপরই বোতাম টিপে দিল রানা। দুর দুর করে উঠল রানার বুকের। ভিতরটা অজানা আশঙ্কায়। কী ঘটতে চলছে সে-ই কি জানে ভালমত?
পানি! ভয়ানক জোরে পানি এসে ঢুকল ঘরের মধ্যে। ভাগ্যিস পানির তোড়টা প্রথমে গিয়ে ধাক্কা খেল অপর দিকের দেয়ালে, নইলে কিছুতেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারত না ওরা। এক সেকেণ্ডেই কোমর পর্যন্ত উঠে এল পানি। বোতামটা ছেড়ে দিল রানা’। ততক্ষণে পানি উঠে এসেছে গলা পর্যন্ত। বন্ধ হয়ে গেল পানি আসবার পথটা।
এবার খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে রানা বলল, সাঁতার জানো, সুলতা?
না। কিন্তু এত জল কোত্থেকে এল ঘরের মধ্যে?
‘এই পাহাড়টার চারদিকেই পানি। আমরা পানির লেভেলের প্রায় নব্বই ফিট। নীচে আছি এখন। পাহাড়টার চারপাশ যখন শুকনো ছিল তখন এই পথ ছিল বাইরে যাতায়াতের জন্যে। এটা আসল গেট না হয়ে কোনও গুপ্ত পথও হতে পারে। এই পথেই আমাদের এখন বেরোতে হবে বাইরে।
ঠিক এমনি সময়ে যে দরজা দিয়ে ওরা এ ঘরে ঢুকেছিল সেই দরজা খানিকটা ফাঁক হয়ে গেল। অতর্কিত পানির এক ধাক্কায় দরজার সামনের লোকটা ছিটকে সরে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই আবার বন্ধ হয়ে গেল দরজা।
‘আমার সমস্ত শরীর জ্বালা করছে পানি লেগে। আমি আর বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারব না, সুলতা। তাড়াতাড়ি সারতে হবে আমাদের সব কাজ। আমি যখন বলব তখন লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে নেবে। বোতাম টিপলেই দরজা খুলে গিয়ে ঘরটা ভরে যাবে পানিতে। সবটা না ভরলে স্থির হবে না পানি, আমরা পানির তোেড় ঠেলে বেরোতে পারব না। পানি স্থির হলে আমরা এই পথ দিয়ে বেরিয়ে সাঁতার কেটে উঠব ওপরে, বুঝলে? ততক্ষণ দম বন্ধ করে রাখতে হবে।