জোরে কয়েকটা টোকা দিল রানা দরজায়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অপর পাশে। এসে গেল প্রহরী।
ক্যায়া বাত, সর্দারজি?
‘আন্দার আও!’ বন্টুর গলা নকল করবার চেষ্টা করল রানা।
কিছু মাত্র সন্দেহ না করে অপ্রস্তুত প্রহরী ঘরে ঢুকেই ধাই করে নাকের উপর খেল রানার হাতের প্রবল এক মুষ্ট্যাঘাত। নাকের জল আর চোখের জল এক হয়ে। গেল প্রহরীর। ততক্ষণে ওর কোমরের হোলস্টার থেকে রিভলভারটা বের করে নিয়েছে রানা। লোকটা একটু সামলে নিতেই ওর দিকে রিভলভারটা ধরে রানা বলল, এই ঘরের চাবিটা বের করো ভালোয় ভালোয়, নইলে ওই অবস্থা করে দেব।’
বল্টুর বীভৎস চেহারার দিকে চেয়ে শিউরে উঠল প্রহরী। বিনা বাক্যব্যয়ে পকেট থেকে চাবি বের করল, ‘ওখানেই মাটিতে রাখো চাবিটা। তারপর খাটের উপর গিয়ে শুয়ে পড়ো।
খাটের সঙ্গে বেঁধে ফেলল রানা প্রহরীকে। তারপর রিভলভারটা ওর বুকের সঙ্গে ঠেসে ধরে বলল, ‘সুলতা রায় কত নম্বর রুমে আছে?
‘হামি জানে না, সারকার।’
‘আলবাত জানে। রিভলভার দিয়ে একটা খোঁচা দিল রানা ওর পাজরে, কাল যে জানানাকে ধরে নিয়ে এসেছে তাকে কোথায় রেখেছে?
‘ওহহো, উও আওরাত? চার তলামে।
কত নম্বর রুম?
‘দো শও ছাপ্পান।’
আর দেরি করা চলে না। পথটা জানাই আছে। ঘরটায় চাবি লাগিয়ে দিয়ে তিনতলায় উঠে এল রানা। পথে কাউকে দেখা গেল না। আয়তনের তুলনায় লোকসংখ্যা বোধহয় কম এখানে। ইএল ৩৬৯-এর সামনে এসে বোতামটা টিপল রানা একবার। সঙ্গে সঙ্গেই দুবার জ্বলে উঠল সবুজ বাতি। আপনা আপনি খুলে গেল দরজা।
কী খবর, বল্টু?’ রেডিয়ো ট্রান্সমিটারের একটা বোতামের ওপর বুড়ো আঙুলটা রেখে ঘড়ির দিকে চেয়ে বসে আছে কবীর চৌধুরী। রানাকে তাই দেখতে পেল না সে। আবার বলল, আর আধ মিনিট, বন্টু! তারপরই ওই টেলিভিশনে দেখতে পাবে…
হঠাৎ ট্রান্সমিটারটা রানার এক লাথিতে ছিটকে গিয়ে দেয়ালে লাগল। সেখান থেকে মাটিতে পড়ে ভেঙে দুই টুকরো হয়ে গেল। হতভম্ব চৌধুরী উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাণ্টামওয়েট চ্যাম্পিয়ন মাসুদ রানার একটা নক আউট পাঞ্চ এসে পড়ল একেবারে নাক বরাবর। গল গল করে রক্ত বেরিয়ে এল নাক দিয়ে। এবার প্রচণ্ড এক লাথি চালাল রানা। লাথি খেয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল কবীর চৌধুরী। তক্ষুণি রানার গুলি করা উচিত ছিল, কিন্তু তা না করে, এমনিতেই কাবু করে এনেছে ভেবে যেই আরেকটা লাথি মারতে গেছে অমনি খপ করে পা-টা। ধরে ফেলল চৌধুরী। পা ধরে জোরে একটা মোচড় দিতেই পড়ে গেল রানা। মাটিতে। রিভলভারটা ছিটকে হাত দুয়েক দূরে পড়ল।
এবার? এখন কোথায় যাবে?
দাবার ছকটা এক মুহূর্তে পাল্টে গেল যেন। হাতি, নৌকো, মন্ত্রী নিয়ে চারদিক থেকে অপর পক্ষের রাজাকে আটকে নিয়ে যেন দেখা গেল সামান্য ঘোড়ার এক আড়াই চালে নিজেই কিস্তি মাত হয়ে বসে আছি। রানার পা-টা ভেঙে ফেলবার জোগাড় করল কবীর চৌধুরী। এক পা খোঁড়া হলে কী হবে, প্রচণ্ড শক্তি রয়েছে ওই প্রকাণ্ড দেহে। অসহ্য যন্ত্রণায় জ্ঞান হারাবার উপক্রম হলো রানার।
হঠাৎ কী যেন ঠেকল হাতে তুলে দেখল সেই চাবুকটা। প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে উঠল ওর মধ্যে। শুয়ে শুয়েই চালাল ও চাবুক নৃশংসভাবে।
ব্রিজ খেলায় ট্রাম্পের উপর দিয়ে ওভার-ট্রাম্পের মত অবস্থা হলো এবার। কবীর চৌধুরীর দুই হাত বন্ধ। চাবুক বাঁচাতে পা ছাড়লেই রানা রিভলভার তুলে নেবে। হেরে গেল চৌধুরী। সাই সাই চাবুক পড়ছে ওর মুখে-গালে-গলায়-হাতে। নরম মাংস পেয়ে কেটে বসে যাচ্ছে চাবুকটা। তীব্র জ্বালা সহ্য করতে না পেরে রানার পা ছেড়ে দিয়ে ছুটে গিয়ে লুকাল কবীর চৌধুরী একটা বড় আলমারির পিছনে। রানাও তড়াক করে লাফিয়ে উঠে রিভলভারটা কুড়িয়ে নিল মাটি থেকে, তারপর সেটা বাগিয়ে ধরে বলল, মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়াও, কবীর চৌধুরী।
কিন্তু কোথায় চৌধুরী? কেউ নেই আলমারির পিছনে। ক্লিক করে টা তীক্ষ্ণ শব্দ কানে আসতেই রানা বুঝল অদৃশ্য হয়ে গেল কবীর চৌধুরী আলমারির পিছনে দেয়ালের গায়ের কোন গুপ্ত দরজা দিয়ে।
ছুটে বেরিয়ে এল রানা ওই ঘর থেকে। এবার চারতলার দু শ ছাপ্পান্ন নম্বর ঘর। লিফটে করে উঠে এল চারতলায়। কিন্তু সেখানে নম্বরগুলো সবই ছয় শ’র উপরে। রানা ভাবল, মিছে কথা বলল না তো লোকটা? আচ্ছা, অন্য ব্লকের চারতলায়ও তো রাখতে পারে সুলতাকে!
লম্বা করিডোরটার ঠিক মাঝামাঝি এসেই অন্য ব্লকের রাস্তা পেল রানা। এবার দৌড়াতে আরম্ভ করল সে। দেরি হলেই ধরা পড়ে যাবে।
এমন সময় অ্যালার্ম সাইরেন বেজে উঠল পাহাড়ের মধ্যে। সবাইকে সাবধান করে দেয়া হচ্ছে বিপদ সঙ্কেত দিয়ে। একটা মোড় ঘুরতেই দেখল একজন প্রহরী ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে ওর দিকেই আসছিল-ওকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে রিভলভার বের করতে যাচ্ছে। গুলি করল রানা। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল লোকটা সটান মাটিতে। কাছে গিয়ে দেখল রানা শেষ হয়ে গেছে। দেয়ালের গায়ে লেখা পি এমকে ২৫৪। ঝটপট প্রহরীর রিভলভার আর চাবির গোছা নিয়ে এগিয়ে গেল রানা। আর মাত্র দুটো ঘর বাদেই দু’শ ছাপ্পান্ন।
তেমনি চোখ খুলে বসে আছে সুলতা চেয়ারে বাঁধা অবস্থায়। চাবি খোলার শব্দ শুনে নতুন কোনও নির্যাতনের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিল মনে মনে-রানাকে ঘরে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে গেল। ওর হাত-পায়ের বাধন খুলে দিয়ে রানা বলল, ‘জলদি উঠে পড়ো, সুলতা। কোনও দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিয়ো না এখন। সবাই সজাগ হয়ে গিয়েছে। যেমন করে হোক বেরোতে হবে আমাদের এখান থেকে।