সুলতার কথা মনে পড়তেই সচকিত হয়ে উঠল রানা। ওর কি কিছুই করবার নেই? নির্যাতন এবং মৃত্যুর তো আরও পনেরো মিনিট দেরি আছে। এই অবস্থাকে স্বীকার করে নিচ্ছে কেন সে? মনে পড়ল রাহাত খানের একটা কথা: ‘কোনও অবস্থাতেই কখনও হাল ছেড়ে দিয়ো না, রানা। মনে রেখো, যে কোনও বিপদ থেকে রক্ষা পাবার কিছু না কিছু উপায় সব সময়ই থাকে। রানা ভাবল, আমার অবস্থায় পড়লে টের পেতে, বাছাধন। সাততলার অফিসে বসে আর উপদেশ খয়রাত করতে হত না।
কী আজেবাজে কথা ভাবছে সে! মাথাটা ঝাঁকি দিয়ে নিজেকে সজাগ করবার চেষ্টা করল রানা। হাত এবং পা খাটের পায়ের সঙ্গে টেনে বাধা। একটু নড়াচড়া করবার উপায় নেই। নিজেকে মুক্ত করার কোনোই উপায় নেই?
হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেল রানার মাথায়। আধমিনিট চুপচাপ পড়ে থেকে দেহমনের সমস্ত শক্তি একত্রীভূত করবার চেষ্টা করল সে। তারপর এক হেঁচকা টানে খাটের ডানধারটা বেশ খানিকটা শূন্যে উঠিয়ে ফেলল। ডানধারটা যেই ফিরে এসে মাটি স্পর্শ করল অমনি আরেক ক্ষিপ্র এবং প্রবল হেঁচকা টানে খাটের বা ধারটা শূন্যে তুলে ফেলতেই উল্টে যাবার সময় ছয় ইঞ্চি পুরু জাজিমটা সড়সড় করে পায়ের তলা দিয়ে সরে গেল ডান দিকে বেশ খানিকটা। বা পা-টা ঢিল পেল। ইঞ্চি ছয়েক। সেই পা দিয়ে দুটো লাথি মারতেই ওটা পায়ের দিক থেকে বেরিয়ে গেল খাটের বাইরে। ডান পা-টাও ঢিল পেল এবার। এবার হার্ট দিয়ে কয়েকটা ঠেলা দিতেই পিঠের উপর থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে গিয়ে মেঝেতে পড়ল জাজিমটা। হাত দুটোও ঢিল পেল ছয় ইঞ্চি।
অমানুষিক শক্তিতে হেঁচকা টান দেয়ায় কব্জিতে চেপে বসে গিয়েছিল রশি, মিনিট পাঁচেক ধরে নখ দিয়ে খুঁটবার পর মুক্ত হয়ে গেল ডান হাত। বাঁ হাত এবং দুই পা খুলতে আর এক মিনিট সময় লাগল।
প্রথমেই খাটটা জায়গা মত ঠিক করে রেখে জাজিম তুলে দিল রানা খাটের উপর। তারপর বিশ্রাম নিল কিছুক্ষণ খাটে বসে।
হঠাৎ ঘরের এক কোণে একটা বাতি জ্বলে উঠল। চমকে সেদিকে চেয়ে। দেখল রানা ওটা টেলিভিশন সেট। কাপ্তাই বাঁধটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তাতে। নিশ্চিন্ত মনে লোকজন চলাচল করছে। রাস্তা দিয়ে দু’জন লোক একটা ওয়ান ফিফটি হোণ্ডা মোটরসাইকেল নিয়ে দ্রুত চলে গেল বাঁধের উপর দিয়ে। স্বাভাবিক
স্বচ্ছন্দ কাপ্তাইয়ের পরিবেশ। তবে কি শেষ পর্যন্ত তার বক্তব্য আজগুবি মনে করে। উড়িয়ে দিল মি. লারসেন আর এসপি আতাউল হক?
আর সময় নেই। কয়েক মিনিট পরেই ঘটবে প্রলয় কাণ্ড। উঠে গিয়ে ঘরের দেয়াল পরীক্ষা করে দেখল রানা দরজা খোলার কোনও উপায় পাওয়া যায় কি না। নাহ। কোনও বোম নেই ঘরের মধ্যে। হঠাৎ দরজার কাছে পায়ের শব্দ শুনে ছুটে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল রানা। ক্লিক করে দরজা তালা খোলার শব্দ পাওয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গেই উজ্জ্বল বাতি জ্বলে উঠল ঘরের মধ্যে। হাতে পায়ে আলগা করে দড়ি পেঁচিয়ে চিৎ হয়ে পড়ে থাকল রানা ঘাপটি মেরে।
পরক্ষণেই ঘরে ঢুকল বন্টু। একা। হাতে একটা প্লেটের উপর কিছু ফলমূল কেটে সাজানো। সন্তর্পণে দরজাটা বন্ধ করে এগিয়ে এল বন্টু খাটের কাছে।
‘দ্যাখ, হারামজাদা, চৌধুরী সাহেব কত বড় দয়ালু মানুষ। মরার আগেও বিকেলের নাস্তা পাঠাতে ভোলেননি।
কাঁটা চামচ দিয়ে আপেলের একটা টুকরো তুলে রানার মুখে দিল বন্টু। তারপর হঠাৎ রানার বাঁ গালটা কাঁটা চামচ দিয়ে জোরে আঁচড়ে ছিলে দিল। বলল, ‘বেঁটে বাঁদরের খামচি। বুঝলি, শালা হারামখোর?
টপ টপ করে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ল রানার গাল বেয়ে। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিল রানা। টু শব্দ পর্যন্ত করল না। কিন্তু দ্বিতীয় টুকরো খাওয়াবার পর যখন আবার নাকে খামচি দিতে এল, তখন এক ঝটকায় কাটা চামচটা হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বন্টুর বাম চোখের মধ্যে বসিয়ে দিল ধাই করে।
‘গ্যাক করে একটা বিটকেল শব্দ বেরোল বন্টুর গলা দিয়ে। এমন ঘটনা যে ঘটতে পারে তা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। চামচটা টান দিয়ে বের করে নিতেই রক্ত ছুটল বন্টুর চোখ দিয়ে। তিন চারটে রেখায় নেমে এল সে-রক্ত গাল বেয়ে। রানা চেয়ে দেখল কাঁটা চামচের কাঁটাগুলোয় বন্টুর চোখের ভিতরের সাদা অংশ। লেগে আছে।
এবার লাফিয়ে উঠে ওর কণ্ঠনালী চেপে ধরল রানা। তারপর ঠেলতে ঠেলতে দেয়ালের গায়ে নিয়ে গিয়ে ঠেসে ধরল প্রাণপণে। ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বন্টুর ডান চোখটা কোটর ছেড়ে। রানার হাত ছাড়াবার চেষ্টা করল সে। ওর আঙুলের নখগুলো বসে গেল রানার কব্জিতে। কিন্তু সে কয়েক সেকেণ্ডের জন্য। হাত দুটো ঝুলে পড়ল দু’দিকে। অল্পক্ষণের মধ্যেই আধহাত জিভ বেরিয়ে পড়ল বন্টুর। পুরো দুই মিনিট পর ছেড়ে দিতেই একটা পা ভাঁজ হয়ে হুমড়ি খেয়ে সামনে পড়ল বন্টুর মৃতদেহ। মৃদু একটা ঘড় ঘড় শব্দ বেরোল বন্টুর গলা দিয়ে। রানা বুঝল, ফুসফুসটা তার স্বাভাবিক অবস্থায় আসবার জন্যে খানিকটা বাতাস গ্রহণ করল বাইরে থেকে।
বল্টুর কাছে কোনও অস্ত্র পাওয়া গেল না। আস্তে করে দরজাটা খুলে একটু ফাঁক করে দেখল রানা কিছুদূরেই পায়চারি করে বেড়াচ্ছে কোমরে রিভলভার ঝোলানো একজন প্রহরী। রানার হাত-পা বেঁধেও নিশ্চিত হতে পারেনি। চৌধুরী-চব্বিশ ঘণ্টা পাহারার ব্যবস্থা করেছে।