তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করবার তাগিদ অনুভব করল ইসলাম। অনায়াসে গোটা আষ্টেক মাছ মারল সে হার্টুন দিয়ে। তারপর একটা সরু শক্ত দড়ি দিয়ে মাছগুলোকে বেঁধে নিয়ে তেরো নম্বরের মাথার ঢাকনিটা খুলে আলগা করে দিল।
একহাতে হার্টুন আর মাছের দড়ি আর অন্য হাতে তেরো নম্বরের মৃতদেহটা ধরে এবার টেনে নিয়ে চলল ইসলাম উপরে। মাঝপথে আসতেই দেখা গেল আবদুল নামছে নীচে। আবদুলের হাতে মৃতদেহটার ভার দিয়ে আগে আগে উপরে উঠে এল ইসলাম।
বাঁধের উপর এখন অনেক লোক জড়ো হয়েছে। কয়েকজন গার্ডও এসে গেছে। একজন গেছে থানায় ওসি সাহেবকে ডাকতে। রীতিমত হুলস্থুল কাণ্ড।
খোঁড়াতে খোঁড়াতে উপরে উঠে এল ইসলাম। মাথা থেকে ঢাকনিটা খুলতেই লারসেন সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘লোকটা কোথায়? মাছ কীসের?’
‘আবদুল আনছে লোকটাকে। ব্যাটা হার্টুন দিয়ে আমাকে প্রায় খুন করার জোগাড় করেছিল। নেমে দেখি ভদ্রলোক বাঁধের গায়ে বসে বসে মাছ মারছেন।’
‘আই সী! তা হলে মাছ চুরি হচ্ছে রিজারভয়ের থেকে এই কায়দায়। আমি ভেবেছিলাম, না জানি কী। তুমি জখম হওনি তো?
না, বেকায়দায় পড়ে পা-টা শুধু মচকে গেছে। ভেঙেও গিয়ে থাকতে পারে। এক্ষুণি হাসপাতালে যাওয়া দরকার।’
এমন সময় আবদুল উঠল লোকটাকে নিয়ে। সবাই ধরাধরি করে কাটাতারের এপাশে নিয়ে এল দেহটা। আবদুলের চোখে চোখ পড়তেই অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিল রাফিকুল ইসলাম।
এরপর আর্টিফিশিয়াল রেসপিরেশনের চেষ্টা-কীভাবে ধস্তাধস্তিতে লোকটার মাথার ঢাকনি খুলে গেছে তার মনগড়া বিবরণ, পুলিশের ডায়েরি, হাসপাতাল, পোস্টমর্টেমের ব্যবস্থা।
কালো শেভ্রোলের বিলীয়মান ব্যাক লাইট দুটোর দিকে চেয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে আবদুল বলল, ‘শুয়ার কা বাচ্চা!
২
টেবিলের উপর পরিপাটি করে সাজানো রয়েছে ব্রেকফাস্ট।
এক গ্লাস অ্যাপল জুস কয়েক ঢোকে শেষ করে ঠক করে টেবিলের উপর নামিয়ে রাখল গ্লাসটা পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের উজ্জ্বলতম তারকা শ্রীমান মাসুদ রানা-বয়স আটাশ, উচ্চতা পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি, গায়ের রঙ শ্যামলা, সে বাংলায় কথা বলে।
সকাল তখন আটটা। দশটার দিকে অফিসে একবার নিয়মিত হাজিরা দিয়ে আজ যাবে ক্লাবের সুইমিং পুলে-মিস ক্লডিন আর ডরোথিকে কথা দিয়েছে সাঁতার শেখাবে। দশটার এখন অনেক দেরি। তাই ধীরে সুস্থে পাউরুটির দুটো কাঁচা আর দুটো মচমচে টোস্টের উপর এক আঙুল পুরু করে চিটাগাং-এর ভিটা মাখন লাগিয়ে নিল রানা। পরিজ আর সেই সঙ্গে দুধের বাটিটা ঠেলে সরিয়ে দিল ডান ধারে, খেল না। তারপর একটা কাঁচা রুটির উপর কোয়েটা থেকে আনানো হান্টারস বিফ কেটে স্লাইস করে সাজিয়ে এক কামড় দিল। সেই সঙ্গে এক প্লেট স্ক্র্যাম্বলড় এগের থেকে এক এক টেবল শূনফুল অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকল। বিফ শেষ হতেই আরেকটা স্লাহঁসের উপরে সাজানো হলো ক্রাফট পনির। মিনিট খানেকের মধ্যে সেটাও যখন শেষ হয়ে এল তখন মচমচে টোস্টের উপর হাল্কা করে মিচেলসের গুয়াভা জেলি লাগানো হলো–সেই সঙ্গে চলল গোটা দুই ইয়া বড় মুন্সিগঞ্জের অমৃতসাগর কলা। তারপর ফ্রিজ থেকে সদ্য বের করা বোতল থেকে ঠাণ্ডা পানি ঢেলে নিল রানা একটা গ্লাসে। তিন ঢোকে গ্লাসটা শেষ করতেই ঘরে ঢুকল রাঙার মা।
বুড়িকে এক নজর দেখে নিয়ে নিশ্চিত মনে আরাম করে সোফায় হেলান দিয়ে জুতোসুদ্ধ পা তুলে দিল রানা টেবিলের উপর। তারপর একটা সিনিয়র সার্ভিস ধরিয়ে চোখ বন্ধ করে মারল কষে লম্বা টান। চোখ বন্ধ করেই ও অনুভব করল ফরসা টেবিলক্লথের উপর রাখা জুতো জোড়ার দিকে একবার চেয়ে নিয়ে বুড়ি পট থেকে কফি ঢেলে রানার হাতের কাছে টি-পয়ের উপর রাখল, তারপর নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
পরপর দু’কাপ কড়া কফি খেয়েও গতরাত্রি জাগরণের গ্লানিটা শরীর থেকে গেল না মাসুদ রানার। কদিন ধরে কিছু কাজ নেই হাতে। আজ টেনিস, কাল গলফ, পরশু সুইমিং, তার পরদিন রোয়িং, ফ্লাইং, ডান্সিং, ব্রিজ ইত্যাদি করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে রানা। খাঁচায় বন্দি বাঘের মত ছটফট করছে তার বিপদ আর রোমাঞ্চপ্রিয় মনটা। গত রাতে তিনটে পর্যন্ত পোকার খেলেছে ক্লাবে-সেই সঙ্গে চলেছে প্রচুর পরিমাণে স্কচ উইস্কি, এবং তারপর…
একা মানুষ। ৫/১-বি পুরানো পল্টনে ছোট্ট একটা একতলা বাড়ি ভাড়া করে আছে সে। তিনখানা বড় বড় ঘর। লাইট, কল, অ্যাটাচড বাথ, কিচেন, সার্ভেন্টস কোয়ার্টার, সব ব্যবস্থা ভাল। গাড়ি-বারান্দার সামনে ছোটখাট বেশ সুন্দর একটা লন’ আছে। ভাড়া পাঁচ শ’ টাকা। অফিস থেকেই ভাড়া পায় মাসে মাসে বাড়িওয়ালা। ধনীর দুলাল সেজে থাকতে হয় রানাকে অফিসের হুকুমেই।
ঘর তিনখানার একখানা রানার বেডরুম, একটা ড্রইংরুম; বাকিটা খালি পড়ে থাকে হঠাৎ যদি কোনও অতিথি এসে পড়ে, সেই অপেক্ষায়।
মোখলেস বাবুর্চির হাতে ইংলিশ খানা খাচ্ছিল এতদিন, হঠাৎ বছর দুয়েক আগে একদিন রাঙার মা এসে উপস্থিত হলো। জিজ্ঞেস করল, ‘ও আব্বা, রান্নার নোক নাগবি?
প্রথম দর্শনেই রানার পছন্দ হয়ে গেল বুড়িকে। বয়স পঞ্চান্নর উপর, দাঁত একটাও নেই। এ বয়সেও শরীর একেবারে ঢিলে হয়ে যায়নি-আঁটসাট কর্মঠ চেহারা। আর আসল কথা হলো, কেন জানি রানার নিজের মরা মায়ের কথা মনে পড়ল ওকে দেখে। কোথায় যেন মিল আছে। বলল, ভাল পাক করতে জান?