কথাটা শোনাল ঠিক নালিশের মত। মৃদু হেসে মাথাটা আবার একবার ঝকাল রানা। তারপর কবীর চৌধুরীর দিকে জিজ্ঞাসু নেত্রে চাইল সে।
‘আমার এক অনুচরকে গত রাতে আপনাদের আবদুল হাই বন্দি করেছে। চট্টগ্রামে। মিলিটারি আমার বাড়িটা দখল করে নিয়েছে আজ সকালে। তাতে কিছুই এসে যেত না, কিন্তু আমার অনুচরটির কাছে একটা নোট বইয়ে ডিনামাইট ফাটাবার ওয়েভ লেংথ এবং সিগনাল কোড লেখা ছিল-সেটাও আবদুল হাইয়ের হস্তগত হয়েছে। এখন আমাদের একমাত্র ভরসা সুলতা দেবী।
রানার মনে পড়ল, চৌধুরীর বাড়িতে সুলতা সেই নোট বইয়ে কী যেন লিখে দিয়েছিল। সিগনাল কোড এবং ওয়েভ লেংথই হবে বোধহয়।
‘আমাদের কারোই জানা নেই সে সিগনাল। কিন্তু সুলতা দেবী পণ করেছেন কিছুতেই আমাদের বলবেন না। সারারাত অনেক চেষ্টা করেও বের করা গেল না। ওর কাছ থেকে। তাই আপনাকে একটু কষ্ট দিতেই হলো, মি, মাসুদ রানা।
বন্টুকে ইঙ্গিত করতেই রানার জামা কাপড় খুলে নেয়া হলো। পরনে রইল কেবল ছোট একটা আণ্ডারওয়্যার।
রানার দিকে চেয়েই আঁতকে উঠল সুলতা।
ইশশ! মাগো! এই অবস্থা করেছে তোমাকে পিশাচেরা!’ সমস্ত গায়ে চাবুকের দাগগুলো এখন কালো হয়ে গেছে। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল সুলতার।
ততক্ষণে রানার হাত দুটো আবার ছাতের কড়ার সঙ্গে বাধা হয়ে গেছে। কবীর চৌধুরীর হাতে কালকের সেই চাবুকটা দেখে ভিতরে ভিতরে শিউরে উঠল। রানা একবার।
সুলতা দেবী! মিটার ওয়েভ এবং সিগনাল কোডটা দয়া করে আবার লিখে দিতে হবে আপনাকে। কাগজ কলম তৈরি আছে আপনার হাতের কাছে টেবিলের উপর। যদি এক্ষুণি লিখে না দেন তবে আপনার চোখের সামনে চাবকে খুন করে ফেলব আপনার প্রিয়তম মাসুদ রানাকে। বন্টু, তুমি এক থেকে দশ পর্যন্ত গুণবে। এর মধ্যে যদি সুলতা দেবী মত না পাল্টান তা হলে চাবুক মারতে শুরু করব। আমি।’
সুযোগ পেয়ে বল্টু খুব দ্রুত এক, দুই, তিন, চার গুণতে আরম্ভ করল। সপাং করে খুব জোরে মাটিতে চাবুকটা একবার আছড়ে নিল কবীর চৌধুরী। চমকে উঠল সুলতা।
‘দেব। আমি লিখে দেব!’ চিৎকার করে উঠল সে।
‘ভুল কোরো না, সুলতা। কিছুতেই লিখে দিয়ো না। তুমি লিখে দিলেও আমাকে খুন করবে, না দিলেও করবে। এই শয়তানের কাছে কিছুতেই আত্মসমর্পণ কোরো না তুমি।’
‘তোমাকে চাবুক মারবে, কী করে সহ্য করব আমি?’
‘চোখ বন্ধ করে রাখো, সুলতা।
‘আমার দুই চোখের পাপড়ি কেটে দিয়েছে-চোখ বন্ধ করতে পারি না। খোঁচা লেগে লেগে ঘা হয়ে গেছে। হু হু করে কেঁদে উঠল সুলতা।
মাথার মধ্যে যেন আগুন ধরে গেল রানার। কিন্তু নিরুপায় সে। মনের সমস্ত ঘৃণা, দুই চোখ দিয়ে ঠিকরে বেরোচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে শুধু বলল, ‘কুত্তার বাচ্চা!
‘শাট আপ! গর্জন করে উঠল কবীর চৌধুরী। তারপর সুলতার দিকে ফিরে বলল, আপনি যদি এখন লিখে না দেন, তবে আজ হয়তো ড্যাম ওড়াতে পারব না আমি, কিন্তু আগামী কালই আপনার বদলে আরেকজন আসবে ভারত থেকে। কাজেই এভাবে আমাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারছেন না। চিন্তা করে দেখুন কোনটা করবেন। এক্ষুণি লিখে দিলে হয়তো আপনাদের দুজনেরই জীবন রক্ষা পেতে পারে। হয়তো ঢাকায় ফিরে গিয়ে সুখের নীড় বাঁধবার সুযোগ পেতেও পারেন। আপনারা।
‘বিশ্বাস কোরো না ওর কথা, সুলতা। ও মিথ্যে ধোকা দিচ্ছে, রানা বলল।
‘বেশ, আপনারা যত পারেন ভালবাসাবাসির অভিনয় করুন। আবার দশ পর্যন্ত গোনো, বন্টু। এইবার শেষ সুযোগ দেয়া হবে আপনাকে, সুলতা দেবী।
এক, দুই, তিন… আট, নয়, দশ। সপাং, সপাং। যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল ঘরের মধ্যে দুবার।
‘দোহাই আপনার বন্ধ করুন। আমি লিখে দিচ্ছি।’ কাতরে উঠল সুলতা। তারপর রানার দিকে চেয়ে বলল, আমাকে ক্ষমা কর, রানা, আমি দুর্বল। মেয়েমানুষ মাত্র।
লিখে দিল সুলতা খশ খশ করে। তারপর বলল, কই, আমাদের ছেড়ে দিন এখন।
হাহ হাহ করে হেসে উঠল কবীর চৌধুরী।
কী লিখলেন কে জানে! আগে সত্যিসত্যিই বাধটা উড়ে যাক, তারপর দেখা যাবে। আর তা ছাড়া, তেমন কোনও কথা তো আমি দিইনি; বলেছি, হয়তো রক্ষা পেতে পারেন আপনারা। তার মানে, হয়তো রক্ষা না-ও পেতে পারেন। হাহ, হাহ্ হাহ হাহ হা।’
‘মিথ্যুক, নীচ, পাষণ্ড!’ গর্জে উঠল সুলতা। সঙ্গে সঙ্গেই চাবুকটা পড়ল ওর উরুর উপর। মাগো, তীক্ষ্ণ এক আর্তনাদ। একজন ঠেলে নিয়ে বেরিয়ে গেল চেয়ারে বাধা সুলতাকে। রানা পাগলের মত টানাটানি করল হাতটা ছাড়াবার। জন্যে, বাঁধন আরও চেপে বসল কব্জিতে। রানাকেও খুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল বন্টু ও তার দুই ষণ্ডামার্কা অনুচর। রেডিও ট্রান্সমিটারটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল চৌধুরী।
বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবছে রানা। তখন সন্ধে সোয়া ছ’টা বাজে। আর মিনিট পনেরো পরই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে কাপ্তাই ড্যাম। কেউ আর ঠেকাতে পারবে না কবীর চৌধুরীকে। এতক্ষণে বোধহয় পৌঁছে গেছেন প্রেসিডেন্ট কাপ্তাইয়ে। সঙ্গে আরও অনেকের মধ্যে থাকবেন পিসিআই-চীফ মেজর জেনারেল (অব) রাহাত খান, ওর পিতৃসম একজন মানুষ। মি. লারসেন এখন কী করছে? ওকে গায়েব হয়ে যেতে দেখে এসপি-ই বা কী করছেন? নিচু কোয়ার্টার ছেড়ে উঁচু কোনও বাসায় উঠে গেছেন বোধহয় এতক্ষণে। আর চিটাগাঙের সদা হাস্যময় আবদুল হাই? আর সুলতা?