সুলতাকে কোথায় রেখেছেন?
আজ আর সময় নেই, মি. মাসুদ রানা। আপনি আপনার ঘরে বিশ্রাম নিন গিয়ে। কাল আবার দেখা হবে।’
চেয়ারের বাঁধন খুলে দিতেই উঠে দাঁড়াল রানা। হাত দুটো তখনও পিছমোড়া করে বাঁধা। হঠাৎ ভয়ঙ্কর এক কাজ করে বসল সে। এক লাফে কবীর চৌধুরীর। সামনে গিয়ে ওর তলপেট লক্ষ্য করে মারল এক প্রচণ্ড লাথি। ঠিক জায়গা মত পড়লে সাত দিন আর উঠতে হত না চৌধুরীকে বিছানা ছেড়ে। কিন্তু চট করে। একটু সরে গেল কবীর চৌধুরী। লাথিটা গিয়ে পড়ল ওর ডান উরুর উপর। খট করে কিছু শক্ত জিনিসের উপর লাগল রানার পা। অবাক হয়ে দেখল রানা চৌধুরীর ডান পা-টা খুলে ছিটকে প্যান্টের ফাঁক গলে বেরিয়ে পড়ল মেঝের উপর। ওটা একটা ফাঁপা কাঠের নকল পা। টাল সামলাতে না পেরে সটান মেঝেতে পড়ে গেল চৌধুরীর প্রকাণ্ড দেহটা। এবার বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল। রানা ওর উপর। দুই হাঁটু জড়ো করে ঝপাং করে পড়ল রানা কবীর চৌধুরীর পেটের উপর। হুক করে একটা শব্দ বেরোল চৌধুরীর মুখ দিয়ে।
ঠিক সেই সময় কানের পিছনে পিস্তলের বাঁটের একটা জোরালো আঘাত খেয়ে আঁধার হয়ে গেল রানার চোখ। এক ধাক্কা দিয়ে ওকে সরিয়ে দিল বল্টু চৌধুরীর দেহের উপর থেকে। একটা টেবিলের পায়া ধরে টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল আবার কবীর চৌধুরী। ওপাশ থেকে ছুঁড়ে দিল বন্টু রানার ওয়ালথারটা। খপ করে ধরল সেটা চৌধুরী। রানার বুকের দিকে লক্ষ্য স্থির করতে গিয়ে দেখল রাগে এবং উত্তেজনায় হাতটা কাঁপছে থর থর করে। পিস্তল ফেরত দিয়ে বলল, ‘চাবুক বের করো।’
তারপর চলল এক অবর্ণনীয় নির্যাতন। হাত দুটো ছাতের একটা কড়ার সঙ্গে বেঁধে শরীর থেকে সমস্ত কাপড় খুলে নেয়া হলো রানার।
তিন মিনিট ক্রমাগত চাবুক চালিয়ে হাঁপাতে লাগল কবীর চৌধুরী। শঙ্কর মাছের লেজের চাবুক। চৌধুরীর প্রিয় অস্ত্র। চোখ দুটো জ্বলছে টর্চের মত।
তখনও রানার জ্ঞান সম্পূর্ণ হারায়নি। সারা শরীরে বিষাক্ত বিচ্ছুর কামড়ের মত জ্বালা, শরীরের রক্ত যেন সব মুখে উঠে আসতে চাইছে, কান দিয়ে গরম ভাপ বেরোচ্ছে। রানার তীব্র আর্তনাদ তিন মিনিটেই গোঙানিতে পর্যবসিত হয়েছে। মুখ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছে এখন ওর।
কপালের ঘাম মুছে নিয়ে আবার শুরু করল কবীর চৌধুরী। শরীরের কোনও অংশ বাদ থাকল না আর। চাবুকের লম্বা লম্বা দাগগুলো গায়ের চামড়া চিরে প্রথমে সাদা তারপর লাল হয়ে উঠল। রক্ত গড়িয়ে নামতে আরম্ভ করল নীচের দিকে। জিভটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে রানার।
জ্ঞান হারিয়ে হাত বাঁধা অবস্থায় ঝুলতে থাকল রানার জর্জরিত দেহ। সপাং সপাং আরও কয়েক ঘা বসিয়ে থামল কবীর চৌধুরী। রক্তে ভিজে চটচটে হয়ে গেছে চাবুকের শেষ প্রান্ত।
.
মাঝরাতে জ্ঞান ফিরল রানার। অন্ধকার ঘরে একটা খাটের উপর শুয়ে আছে ও চিত হয়ে। অসম্ভব তেষ্টা পেয়েছে। পাশ ফিরতে গিয়ে টের পেল হাত-পা টান টান করে খাটের পায়ার সঙ্গে বাঁধা। কপালে হাত না দিয়েই বুঝল গায়ে প্রবল। জ্বর। বিস্বাদ হয়ে আছে মুখের ভিতরটা। হঠাৎ এই বোকামি করে ফেলার জন্যে রাগে দুঃখে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে এখন ওর। মনে মনে নিজেকে গাল দিয়ে বলল, ‘বেশ হয়েছে, ঠিক হয়েছে! যেমন কর্ম তেমনি ফল!
হঠাৎ কানের কাছে বেজে উঠল একটা মিষ্টি সুর। গোটা ঘরটা যেন ভরে। গেল সেই সুর মূর্ঘনায়। আরও কয়েকটা শব্দ হতেই রানা বুঝল এ হচ্ছে সরোদের সুর। কেউ সরোদ বাজাচ্ছে। অদ্ভুত মিষ্টি হাত। ভাগ্যিস এ ঘরের স্পীকারটা ‘অন’ করা ছিল। বাজনা তো কতই শুনেছে সে, কিন্তু এত ভাল তো কই লাগেনি কখনও আর! মস্ত বড় কোনও ওস্তাদের বাজনা হবে হয়তো। দেহমনের সব জ্বালা সব বেদনা দূর হয়ে যায় এমন মিষ্টি রাগিনী শুনলে। মনে হয় পৃথিবীটা মায়াবী এক স্বপ্নের দেশ। মিষ্টি চাঁদের আলো, মাতাল হাওয়া, সামনে অথৈ জল, দূরে আবছা গ্রামের আভাস, হিজলের ছায়া, দোল দোল ঢেউ, শাম্পান, আর সেই সঙ্গে ওর তীব্র একাকীত্ব।
মধুর একটা আবেশে জড়িয়ে এল রানার চোখের পাতা। মনে হলো। লেভিটেশনের সাহায্যে যেন তার দেহটাকে ওজনশূন্য করে দেয়া হয়েছে।
দরজায় চাবি লাগানোর শব্দ পাওয়া গেল একটু পরেই। ঘরে এসে ঢুকল বন্টু, সঙ্গে আরও দুজন লোক। বন্টু বলল, ‘চৌধুরী সাহেব তলব করেছেন, একটু কষ্ট করতে হবে হুজুরকে।
খাট থেকে খুলে আবার পিছমোড়া করে বাঁধা হলো রানার হাত দুটো। দুর্বল পায়ের উপর দাঁড়িয়ে নিজের দেহকে অসম্ভব ভারী বলে মনে হলো ওর। কিন্তু কোনও রকম দুর্বলতা প্রকাশ করল না ওদের সামনে। দোতলায় সোডিয়ামের। ঘরটা পার হয়ে সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় উঠে এল ওরা। আবার সেই ইএল ৩৬৯, সবুজ বাতি, কবীর চৌধুরীর নির্বিকার মুখ, প্রতিভাদীপ্ত উজ্জ্বল দুই চোখ।
চমকে উঠল রানা ঘরের মধ্যে সুলতাকে দেখে। ওকে দেখেই সুলতা উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না-চেয়ারের সঙ্গে বাঁধা রয়েছে ওর দেহ। কেবল বলল, তোমাকেও ধরে এনেছে এরা!’
জবাব দিল না রানা; মাথাটা শুধু একটু নিচু করল একবার। দেখল সুলতার দুই চোখের কোলে কালি পড়েছে। অবসন্ন ঘাড়টা যেন মাথাটাকে সোজা রাখতে পারছে না আর।
সারা রাত আমাকে জাগিয়ে রেখেছে এরা এই চেয়ারে বসিয়ে চোখের। সামনে বাতি জ্বেলে।