আত্মতৃপ্তির একটা হাসি ফুটে উঠল কবীর চৌধুরীর মুখে।
‘আজকাল বিলেতে ওরা হুভার ক্র্যাফট তৈরি করছে জলে ডাঙায় সবখানে চলবার জন্যে। বাতাসকে প্রেশারাইজ করে এই গাড়ি মাটি বা পানি থেকে এক ফুট উঁচুতে থাকবে সবসময়-চলবে জেট প্রপালশনে। শুনছি নাকি ইংলিশ চ্যানেলের উপর হুভার-ক্র্যাফটের ডেইলি-প্যাসেঞ্জারি শুরু হবে অল্পদিনেই। কিন্তু এসবের চাইতে আমার জেট কতখানি উন্নত মানের হবে ভাবুন একবার।
চুপচাপ কিছুক্ষণ পাইপ টানল কবীর চৌধুরী। রানাও একটা সিগারেট চেয়ে নিল।
‘যা বলছিলাম-এই লেভিটেশন। এ ব্যাপারটা পৃথিবীতে নতুন কিছুই নয়; এবং এর প্রিন্সিপলটাও খুবই সহজ। মিশরের পিরামিড হচ্ছে পৃথিবীর সপ্ত। আশ্চর্যের একটি। আজকে কারিগরি বিদ্যার এত উন্নতির পরও বিংশ শতাব্দীতে আরেকটা পিরামিড তৈরি করা অসম্ভব। কেন জানেন? আজকের বড় বড় ইঞ্জিনিয়াররা মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও বের করতে পারেনি অত প্রকাণ্ড সব পাথর অখণ্ড অবস্থায় পিরামিডের অত ওপরে কী করে তোলা সম্ভব হলো। আমার, এবং আমার বন্ধুদ্বয়ের বিশ্বাস সেই যুগে অর্থাৎ আজ থেকে পাঁচ ছ’হাজার বছর আগেই মিশরীয়রা এ বিদ্যা আয়ত্ত করেছিল, এবং লেভিটেশনের সাহায্যেই প্রত্যেকটা পাথরকে ওজন-শূন্য করে নিয়ে অত ওপরে উঠিয়েছিল অনায়াসে।
এসব আজগুবি গল্প নীরবে হজম করে চলেছে রানা। আবার আরম্ভ করল কবীর চৌধুরী।
‘আরেক দিকে ছ’জন বৈজ্ঞানিক রিসার্চ করছেন পারমাণবিক অস্ত্র সম্পর্কে। আমরা আণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চাই না। প্রয়োজনের সময় যেন বৃহৎ শক্তিবর্গের এই ঠুনকো অস্ত্র বানচাল করে দিতে পারি সে উদ্দেশ্যেই এই গবেষণা আমাদের। আটটা সুপার-কম্পিউটারের পাঁচটাকেই ওইখানে দেখেছেন। আর দেখেছেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম অ্যাটম স্ম্যাশার। এর সঙ্গে তুলনা করা যায় এমন আর একটা মাত্র স্ম্যাশার শুধু পাবেন আমেরিকার ব্রুক হ্যাঁভেন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে। আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছি আমরা এই ব্যাপারে।
দেয়াল ঘড়িটার দিকে একবার চেয়ে নিয়ে চৌধুরী বলল, আমার হাতে বেশি সময় নেই। আন্ট্রা সোনিকস গেল, লেভিটেশন গেল, অ্যাটমিক রিসার্চ গেল, এখন অ্যান্টি-ম্যাটার। পৃথিবীবিখ্যাত পদার্থবিদ ডক্টর আর্থার ডুনিং এবং তার স্ত্রী। গবেষণা করছেন এ নিয়ে। প্রতিটি অ্যাটমের একটা অ্যান্টি-অ্যাটম আছে। প্রতি…’
‘এসব শুনে আমার কোনও লাভ নেই, রানা বাধা দিল, তা ছাড়া ভালও লাগছে না শুনতে। বুঝলাম, আপনারা কয়েকজন বিকৃতমস্তিষ্ক বৈজ্ঞানিক বিকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করছেন বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে। কিন্তু এর সঙ্গে কাপ্তাই বাঁধের কী সম্পর্ক? ৮ ‘দুই বর্গমাইল জুড়ে ছিল আমার গবেষণাগার। আরও আটটা অপেক্ষাকৃত নিচু টিলা আমার বহু মূল্যবান যন্ত্রপাতিসহ ডুবে গেছে পানির তলায়। আর পনেরো দিনের মধ্যে এইটাও যেত। তাই উড়িয়ে দিচ্ছি আমি বাঁধটা।
‘লক্ষ লক্ষ মানুষকে সেজন্যে খুন করবেন আপনি?
‘দেখুন, আমার কষ্টার্জিত হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে আমি তৈরি করেছি। এই গবেষণাগার। মাত্র কয়েক লক্ষ প্রাণের চাইতে এর দাম আমার কাছে অনেক বেশি। আগামী পঁচিশ বছরের মধ্যে পাকিস্তানের লোকসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। তখন এই ক্ষতিকে লাভই মনে হবে।’ মৃদু হাসল কবীর চৌধুরী। পানি এখন চুঁইয়ে চুঁইয়ে পাহাড়ের ভেতরে ঢুকতে আরম্ভব করেছে। আজ দেখি সোডিয়ামের ঘরের দেয়ালও ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেছে। অতগুলো ড্রামের সোডিয়ামে যদি কোনও ভাবে পানি বা অক্সিজেন ঢোকে, তবে চুরমার হয়ে যাবে গোটা পাহাড়।
রানার মনে পড়ল একটু আগে একটা ঘরের ভিতর দিয়ে যাবার সময় বড় বড় অনেকগুলো ড্রাম দেখেছে সে। সিগারেটটা পুড়তে পুড়তে ঠোঁটের কাছে চলে এসেছে, নাকের ভিতর গরম ধোয়া ঢুকে ঝঝ লাগছে রানার। ইঙ্গিত করতেই বন্টু সেটা নিয়ে অ্যাশট্রেতে ফেলল।
ইণ্ডিয়ার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কীসের?
‘প্রয়োজনের সময়ে রামকেও বানরের সাহায্য নিতে হয়েছিল। বাঁধটা ভাঙবার প্রয়োজন যখন হলো তখন তাদের সাহায্য চাইলাম। খুশি হয়ে তারা এগিয়ে এল সাহায্য করতে। তবে তাদের একটা ছোট্ট অনুরোধ: প্রেসিডেন্ট যখন প্রজেক্ট ওপেন করতে আসবে সেই সময় ফাটাতে হবে ডিনামাইট। রাজি হতেই হলো!’
উত্তেজিত রানার মুখটা হাঁ হয়ে গেল। লোকটা মানুষ না পিশাচ! কী। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে যাচ্ছে কথাগুলো!
আপনার দিন ঘনিয়ে এসেছে, মি. কবীর চৌধুরী। আপনার পরিচয় আর কারও কাছে গোপন নেই। চিটাগাং আর কাপ্তাইয়ের…
‘আমি জানি সে সব। আপনি আমাকে আর গোপন থাকতে দেননি। এর ফলে বহু প্রাণ নষ্ট হবে। কিন্তু ওই যে বললেন দিন ঘনিয়ে আসা-সেটা একেবারে অসম্ভব। আপনাকে বলেছি আমার মারণাস্ত্রের কথা। পৃথিবীর কারও সাধ্য নেই আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এ-পাহাড়ের ধারে কাছে আসে। পাকিস্তানের গোটা মিলিটারি ফোর্সও যদি এক সঙ্গে আসে, এক নিমেষে ছাই করে দিতে পারি আমি এই ঘরে বসে শুধু ছোট্ট একটা বোতাম টিপে।
‘কিন্তু বাঁধ আপনি ওড়াবেন কী করে? কড়া পাহারা রয়েছে। সেখানে-ডিনামাইট বসাতেই পারবেন না আপনি।
বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠল কবীর চৌধুরীর মুখে। বলল, ‘ডিনামাইটগুলো জায়গা মত বসেই আছে, মি. রানা। যে তিন জায়গা আজ দুপুরে এত লোক নামিয়ে তন্নতন্ন করে খোঁজালেন, ঠিক তার থেকে তিন গজ করে বাঁয়ে সত্তর ফিট পানির নীচে বসানো আছে ডিনামাইট। বাধের গায়ে গর্ত খুঁড়ে সেগুলো বিশ ফুট ঢুকিয়ে দিয়ে আবার মাটি চাপা দেয়া হয়েছে। কারও সাধ্য নেই ওগুলো খুঁজে বের করে। কাল সাড়ে ছ’টা থেকে সাতটার মধ্যে আপনি নীচতলার একটা ঘরে শুয়ে টেলিভিশনে দেখতে পাবেন-শত চেষ্টা করেও আপনি আমাকে রুখতে পারলেন না-বাঁধ আমি উড়িয়ে দিলাম। প্রেসিডেন্ট বক্তৃতা শেষ করে বোতাম টিপবে, জ্বলে উঠবে সমস্ত বাতি, পরক্ষণেই ঘটবে মহাপ্রলয়। তারপর একটা বোতামে চাপ দিলেই ধীরে ধীরে পানি উঠতে শুরু করবে আপনার ঘরে। চট করে ঘরটা ভরবে না পানিতে-এর মধ্যে আরও অনেক মজা আছে। সবই আমার স্বকীয় উদ্ভাবন। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না কতখানি ভয়ঙ্কর এবং বিভীষিকাময় হতে পারে আমার মৃত্যুদণ্ড.। আগে থেকে এর বেশি আর কিছুই বলব না, বললে এর আকস্মিকতা কমে যাবে আপনার কাছে।