‘নিশ্চয়ই। মরতে যখন হবে, জেনে মরি। তবে তার আগে আপনার এই বেঁটে বাদরটাকে বলুন আমার পকেট থেকে সিগারেট কেসটা বের করে একটা সিগারেট ধরিয়ে দিক।’ ভীত হয়ে পড়েছে এমন ভাব দেখাতে চায় না রানা।
চৌধুরীর ইঙ্গিতে বেঁটে লোকটা রানার পকেট থেকে ওয়াটারপ্রুফ কেসটা বের করে একটা সিগারেট ধরিয়ে দিল রানার ঠোঁটে। তৃপ্তির সঙ্গে গোটা কয়েক টান দিয়ে রানা বলল, ‘শুনি, কী নিয়ে পাগলামি চলছে আপনাদের।’
কয়েক সেকেণ্ড রানার চোখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে মৃদু হাসল চৌধুরী। বলল, ধৃষ্টতা আমি সহ্য করি না, মি. মাসুদ রানা-চট্টগ্রামে তার প্রমাণ পেয়েছেন। কিন্তু এখন আপনাকে আমি কিছুই বলব না। তার কারণ আপনার কথায় কণা পরিমাণ হলেও সত্যতা সত্যিই আছে। পাগলামিই বটে। লোভও বলতে পারেন। প্রচণ্ড ক্ষমতার লোভ। থাস্ট ফর পাওয়ার। পৃথিবীতে সবাই চায় সার্থকতা। মানবজীবনের সার্থকতা তার পরিপূর্ণ আত্মবিকাশে। আমি নিজেকে কর্ষণ করে প্রভূত ক্ষমতা অর্জন করেছি। কোনও মহাপুরুষ যদি অসামান্য প্রতিভা নিয়ে জন্মে এবং নিজ প্রতিভাবলে প্রচণ্ড ক্ষমতার অধিকারী হয়ে গোটা পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় এনে তার ইচ্ছেমত ঢেলে সাজাতে চায়, তবে তাকে আপনার মত সাধারণ লোক তো পাগলই বলবে। বন্টু, তুমি মাসুদ সাহেবকে সমস্ত গবেষণাগার ঘুরিয়ে দেখিয়ে নিয়ে এসো। আমি ততক্ষণে কয়েকটা কাজ সেরে নিই।
একটা যন্ত্রের ওপর ঝুঁকে পড়ল চৌধুরী। রানাকে চেয়ারসুদ্ধ ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে বন্টু, কবীর চৌধুরী আবার বলল, ‘কেবল ঘুরিয়ে দেখাবে, কারও সঙ্গে কোনও কথা বলতে দেবে না। মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেল বন্টু। রানা ভাবল, বল্টু! নামটা বড় মানানসই হয়েছে। বন্টুর মতই বেঁটে খাটো শক্ত সমর্থ চেহারা লোকটার।
একটা পাহাড়ের মধ্যে যে এমন বিরাট কারবার চলতে পারে তা রানার ধারণার বাইরে ছিল। পথ তো নয় যেন গোলক ধাঁধা। এদিক থেকে ওদিকে, ওদিক থেকে আরেক দিকে কখনও লিফটে উঠছে, কখনও আপনাআপনি দরজা খুলে গিয়ে পথ তৈরি হচ্ছে। ঝকঝকে তকতকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মোজাইক ফ্লোর। মুখ দেখা যায়। অবাক হয়ে রানা যা দেখল তাতে বুঝতে পারল আধুনিকতম যন্ত্রপাতির সাহায্যে কয়েকজন সুশিক্ষিত বৈজ্ঞানিক দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করছে যেন কী এক নেশার ঘোরে। এত সব যন্ত্রপাতির মধ্যে কেবল গোটা কতক কম্পিউটার দেখে চিনতে পারল রানা। বোঝা গেল ফালতু লোক এরা নয়। মিথ্যে ভড়ং করেনি কবীর চৌধুরী। সত্যি সত্যিই বিরাট কিছু কাজ চলছে এই পাহাড়ের মধ্যে। মিনিট বিশেক পক্ষাঘাতে পঙ্গু রোগীর মত চেয়ারে বসে ঘুরে ঘুরে বিরক্ত হয়ে উঠল রানা। বলল, কথা বলতে দিচ্ছ না যখন, তখন কিছুই না বুঝে শুধু শুধু এভাবে বোকার মত ঘোরার কোনও মানে হয় না। ফিরে চলো।’
এত তাড়াতাড়ি ওদের ফিরে আসতে দেখে অবাক হলো চৌধুরী।
এরই মধ্যে সব দেখা হয়ে গেল?
‘দুই সেকশন দেখেই ফিরে এসেছে,’ জবাব দিল বন্টু।
কীসের গবেষণা হচ্ছে বুঝতে না পারলে শুধু শুধু ঘুরে লাভ কী?
দেখুন, বিজ্ঞান এই বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এমন এক পর্যায়ে চলে। এসেছে, এত স্পেশালাইজড হয়ে পড়েছে এর প্রত্যেকটি শাখা-প্রশাখা যে, আপনি তো কলা বিভাগের গ্র্যাজুয়েট মাত্র-একজন ভিন্ন শাখার বৈজ্ঞানিকেরও আপনার দশাই হত এই গবেষণাগারে ছেড়ে দিলে। তথ্যগাণিতিকের হিসেবে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রতি পনেরো বছরে আমাদের এতদিনকার সঞ্চিত জ্ঞানের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতিটা কল্পনা করুন একবার! এবং এই অগ্রগতির সবচাইতে পুরোভাগে রয়েছি আমরা-এই গুপ্ত পাহাড়ের গোপন বৈজ্ঞানিকেরা। এক মহা পরিকল্পনাকে সামনে রেখে এগিয়ে চলেছি আমরা দ্রুত সাফল্যের দিকে।
‘সে তো খুব ভাল কথা, কিন্তু এর মধ্যে আবার বাঁধটা ভাঙার মতলব ঢুকল কেন মাথায়?
বলছি। তার আগে আমাদের গবেষণার কথা বলে নিই। আমার নিজের রিসার্চ হচ্ছে আট্রা-সোনিক্স। অতিশব্দ। সব কথা আপনি বুঝবেন না-মোটামুটি জেনে রাখুন প্রচণ্ড শক্তি আছে এই অতিশব্দের। একে বশে এনে আমি পারমাণবিক অস্ত্রের চাইতে বহুগুণ বেশি ক্ষমতাশালী এক অস্ত্র তৈরি করেছি। গোটা পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় আনবার এই আমার প্রথম অস্ত্র। এর ভাল দিকও আছে। সেদিকেও আমার নজর আছে। বিভিন্ন দিক থেকে এই অতিশব্দকে মানব কল্যাণের কাজে লাগানো হবে। পরে সে নিয়ে আরও আলোচনা করা যাবে। এখন অন্যান্য গবেষণাগুলো সম্বন্ধেও মোটামুটি একটা ধারণা দিয়ে নিই আপনাকে।
পাইপটা আবার ধরিয়ে নিল চৌধুরী।
‘আমার দুজন জার্মান বন্ধুকে দিয়ে লেভিটেশন-এর উপর গবেষণা করাচ্ছি। লেভিটেশন হচ্ছে গ্র্যাভিটেশন বা মাধ্যাকর্ষণের ঠিক বিপরীত। কল্পনা করুন, কোনও বস্তুকে যদি মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবমুক্ত করে দেয়া যায় তবে তার কী অবস্থা হয়! শূন্যে ছেড়ে দিলেও সেটা মাটিতে পড়বে না। এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। দুই জার্মান বৈজ্ঞানিক। এ আবিষ্কার বিজ্ঞানের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে এক মহা বিপ্লবের সূচনা। হাজারো রকম কাজে লাগানো হবে এই শক্তিকে। কিন্তু সবচাইতে প্রথম আমি ব্যবহার করব একে আমার জেটে। আমার মহাপরিকল্পনাকে সফল করতে আমার প্রয়োজন: দ্রুততম ট্রান্সপোর্ট। অ্যারোপ্লেন বলুন আর জেটই বলুন এদের সবাইকে কেবল শূন্যে ভেসে থাকবার জন্যই প্রায় অর্ধেকের বেশি শক্তি নষ্ট করতে হয়। আমার জেট আপনিই ভেসে থাকবে, পুরো শক্তি ব্যবহার করব আমি কেবল এগিয়ে যাবার কাজে। বুঝতে পারছেন?