পরিষ্কার আলোতে এসে আবদুলের হত্যাকারীর দিকে ভাল করে চাইল রানা। বেঁটে লোকটা। খুব বেশি হলে সোয়া পাঁচ ফুট উঁচু হবে। কিন্তু শরীর তো নয় যেন পেটা লোহা। পরনে খাকি হাফ প্যান্ট আর শার্ট। হাত-পায়ের থোকা থোকা বলিষ্ঠ পেশি দেখলেই বোঝা যায় অসুরের শক্তি আছে ওর গায়ে। মাথায় চুলগুলো কদম ছাঁট দেয়া। ছোট কুতকুঁতে, ধূর্ত চোখদুটো যেন জ্বলছে সারাক্ষণ। চ্যাপ্টা নাকের নীচে কালি মাখানো টুথব্রাশের মত খোঁচা খোঁচা গোফ চেহারার সঙ্গে বেমানান।
ডানধারের দরজাটার সামনে রানাকে ঠেলে নিয়ে যেতেই খুলে গেল সেটা। কোনও রকম বোতামের বালাই নেই, সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই আপনা আপনি খুলে যাচ্ছে দরজাগুলো। খুব ছোট একটা ঘর সামনে। ধাক্কা দিয়ে সেই ঘরের মধ্যে রানাকে ঢোকাল বেঁটে লোকটা। একজন অনুচরের হাতে সাব-মেশিনগানটা দিয়ে। রানার ওয়ালথারটা নিল নিজে। বুড়ো আঙুল দিয়ে ওপর দিকটা দেখিয়ে হুকুম করল, ‘লাশ দুটো নিয়ে নীচতলায় মর্গে চলে যাও তোমরা সব। আমি না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে সেখানে। ওপরে ওঠার আগে রাডার গ্লাসটা দেখে নেবে ভাল করে।
‘ঠিক হ্যায়, সর্দারজি। একজন উত্তর দিল।
এবার রানার পাশে দাঁড়াল বেঁটে সর্দার। দরজাটা বন্ধ হয়ে যেতেই দেয়ালের গায়ে অনেকগুলো বোতামের মধ্যে ডানদিক থেকে তিন নম্বর বোতামটা টিপে দিল লোকটা। নীচু হয়ে রইল বোতামটা অন্যগুলোর চাইতে। নীচে নামতে আরম্ভ করতেই রানা বুঝল এটা একটা লিফট।
লোকটা রানার থেকে মাত্র হাত তিনেক তফাতে। পিস্তলটা আলগা ভাবে। রানার পেটের দিকে মুখ করে ধরা। ঝাঁপিয়ে পড়বে নাকি ও অতর্কিতে? প্রতিশোধের এমন সুযোগ কী পাবে ও আর?
‘হেঁঃ হেঁঃ করে কর্কশ গলার হাসি শুনে রানা ওর মুখের দিকে চেয়ে দেখল বিচ্ছিরি কালো গোঁফটার নীচে ঝক ঝক করছে সাদা দাঁত।
‘ওসব ধানাই-পানাই ছেড়ে দেও, বাপধন। ভাবছ, ঝাঁপিয়ে এসে কাবু করে ফেলবে আমাকে। শালা, উলুকা পাঠা! একবার চেষ্টা করেই দেখো না কেমন মজা!’
সামলে নিল নিজেকে রানা। সড় সড় করে নেমে চলেছে লিফট। চট করে গুনে নিল রানা মোট নয়টা বোতাম আছে দেয়ালের গায়ে। মনে মনে হিসেব করে ফেলল, এখন হয় সাততলায়, না হয় তিনতলায় নামছে ওরা। আধ মিনিট চলার পর থামল লিফট, রানা আন্দাজ করল, তিনতলায় পৌঁছল ওরা। ক্লিক করে একটা শব্দ করে যে দরজা দিয়ে লিফটে ঢুকেছিল তার ঠিক উল্টো দিকের অন্য একটা দরজা খুলে গেল। লিফট থেকে বেরিয়েই একটা দশ ফুট চওড়া মোজাইক করা করিডোর। লম্বা প্রায় পঞ্চাশ গজ হবে। দু’পাশে দেয়ালের গায়ে পরপর নম্বর লেখা। কিছুদূর বাঁয়ে যাবার পর একটা গলি দিয়ে দশ গজ গিয়ে ইএল ৩৬৯ লেখা নম্বরের সামনে দাঁড়াল বেঁটে সর্দার। একটা সাদা বোতাম একবার টিপল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নম্বরটার কিছু উপরে দুবার জ্বলে উঠল সবুজ বাতি। রানাকে এবার দেয়ালের দিকে ঠেলে দিল লোকটা। নাকটা দেয়ালের গায়ে লাগবার আগেই সরে গেল দেয়াল। সিয়িং আই ফটো ইলেকট্রিক সেলের কারবার।
সেই দরজা দিয়ে মস্ত বড় একটা ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়াল রানা। অবাক কাণ্ড! এ যেন পাতালপুরীর রাজপ্রাসাদ। পাহাড়ের ভিতর সবটা এয়ারকণ্ডিশন করা। মেঝেতে ঝকঝকে মোজাইকের টাইলসে মোমপালিশ দেয়া। চারদিকের দেয়াল হাল্কা নীল রঙে ডিসটেম্পার করা। বিভিন্ন আকারের অদ্ভুত সব যন্ত্রপাতি সাজানো রয়েছে প্রকাণ্ড ঘরটায়। গোটা কতক সেগুন কাঠের বড় আলমারি। মোটা মোটা ইংরেজি বই সাজানো তাতে। একটা পড়ার টেবিল। ঘরে কাউকে দেখতে পেল না রানা।
‘এসব যন্ত্রপাতি হাঁ করে দেখা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই, মি. মাসুদ রানা। আপনি কেন, পৃথিবীর কেউই কখনও দেখেনি এ যন্ত্র। বুঝিয়ে না দিলে কিছুই বুঝবেন না এর মাহাত্ম। একটা যন্ত্রের ওপাশ থেকে বেরিয়ে এল কবীর চৌধুরী। আহা, দাঁড়িয়ে কেন, বসুন!
একটা চাকা লাগানো স্টিলের চেয়ারে বসানো হলো রানাকে। চৌধুরীর ইঙ্গিতে একটা নাইলন কর্ড দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা হলো তাকে সেই চেয়ারের সঙ্গে নিপুণভাবে, এক বিন্দু নড়াচড়া করবার ক্ষমতা রইল না আর। সন্তুষ্ট চিত্তে এবার বাঁকা পাইপটা ধরাল কবীর চৌধুরী।
‘আপনার চেহারা দেখে বুঝতে পারছি আমার গবেষণাকেন্দ্র দেখে খুব অবাক হয়ে গেছেন আপনি। কিন্তু আপনি যেটুকু দেখেছেন তা পুরোটার ছত্রিশ ভাগের এক ভাগ মাত্র। এ পাহাড়টাকে লম্বালম্বি চার ভাগ করে নিয়েছি আমি। পাহাড়ের মাথা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যে ঘরটায় এসে লিফটে উঠলেন, সে ঘরের চার দেয়ালে চারটে দরজা দেখেছেন–প্রত্যেকটাই লিফট। একটায় উঠে আমার ল্যাবরেটরিতে এসেছেন। অন্য লিফট দিয়ে নেমে অন্যান্য ল্যাবরেটরিতে যাওয়া যায়। এই রকম আরও তিনটে গবেষণাগারে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করছেন পৃথিবীর দশজন সেরা বৈজ্ঞানিক। এই চার ভাগের প্রত্যেকটি আবার নয়তলা। নীচ থেকে কাজ শুরু করে উপর পর্যন্ত সম্পূর্ণ করতে আমাদের পুরো পাঁচ বছর লেগেছে। এটাকে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ ছোটোখাটো শহর বলতে পারেন।’
কীসের গবেষণা হচ্ছে আপনাদের এখানে?’
‘তা বলতে আমার আপত্তি নেই। তবে তার আগে একটা কথা আপনার জানা দরকার-আপনি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত। আগামী কাল ঠিক সন্ধে সাতটায় এক অভিনব উপায়ে আপনাকে হত্যা করা হবে। এখবর জানবার পরেও কি আমাদের গবেষণা সম্পর্কে জানবার আগ্রহ আছে?’