আবদুলও ডুব দিয়ে হাত দশেক বাঁয়ে ভেসে উঠল। কাছাকাছিই ছিল রানা। বলল, এবার আমি ডুব দিয়ে আরও কিছুদূর এগোব তার ধরে, তারপর আবার ডুব দেবে তুমি।
এই ভাবে প্রায় পাঁচ-ছয় শ গজ যাবার পর ধীরে ধীরে পানির ওপর থেকে তারটার দূরত্ব কমে গেল। একটানা এতক্ষণ সাঁতরাবার পর দুজনেই হাঁপাচ্ছে। কামারের হাপরের মত আওয়াজ করে। কিছুক্ষণ চিৎ। সাঁতার দিয়ে এক জায়গায় পানির ওপর ভেসে থেকে জিরিয়ে নিল ওরা। তারপর পা দিয়ে আলতো করে তারটা ছুঁয়ে এগিয়ে চলল ধীরে ধীরে ব্রেস্ট স্ট্রোক দিয়ে।
হঠাৎ রানার দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে সড়াৎ করে বেরিয়ে ওকে, জোরে একটা লেজের বাড়ি মেরে নিজেই ভয় পেয়ে পাঁচ হাত শূন্যে লাফিয়ে উঠল একটা মস্ত বড় রুই মাছ। ছপাৎ করে ওটা আবার পানিতে পড়তেই হেসে উঠল আবদুল মৃদুস্বরে।
‘আচানক ড ল্যগ গিয়াথা, হাজুর। এ মাছ দু’বরস আগে এ পানিতে ছাড়ল ফিশারি ডিপাটমেন। সওয়া উনিশ লাখ টাকা খোরচা করছে তিনারা। বিয়াল্লিশ লাখ টাকা ইনকাম হোবে, হাজুর। এ বোড়ো আচ্ছা বিজুনিস।’
আরও আধ মাইল এগোবার পর পানি থেকে আট-দশ ফুট উঁচু একটা টিলার মাথা দেখা গেল। তারটা সোজা চলে গেছে সেই ডুবুডুবু টিলার দিকে।
হতাশ হয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল আবদুল। একটা আঙুল ঠোঁটের উপর রেখে চাপা স্বরে রানা বলল, ‘শ শ শ!’
একেবারে নিঃশব্দে এগিয়ে গেল ওরা টিলাটার দিকে। দশ গজ বাকি থাকতেই রানা লক্ষ করল টিলার মাথায় কিছু একটা কাঁচের জিনিস চাঁদের আলোয় ঝিক করে উঠল একবার। থেমে পড়ল রানা। ওটা একটা রেইডার। চারকোণা মুখের এই ‘ডেকা’ রেইডার স্ক্যানার, চারদিকে নজর রাখবার জন্যে বড় বড় জাহাজের ব্রিজের ওপর বসানো থাকে। টিলার ওপর ঘুরছিল ওটা, হঠাৎ রানাদের। দিকে চেয়ে থেমে গেল। অবাক বিস্ময়ে যেন প্রশ্ন করছে নীরবে, কে হে তোমরা? কী চাও এখানে?
ধড়াস করে উঠল রানার বুকের ভিতরটা। আবদুলকে ডুব দেয়ার ইঙ্গিত করে নিজেও ডুব দিল পানির তলায়। কিন্তু এত আলো কীসের? পানির ভেতর চোখ খুলেই টের পেল রানা যে উপরটা এখন আলোকিত। ধরা পড়া গেছে, পালাবার আর পথ নেই। মরিয়া হয়ে ভেসে উঠল ও উপরে। সার্চ লাইটের তীব্র আলোয় ধাধিয়ে গেল চোখ। ঠিক এমনি সময়ে শক্ত একটা রশির ফাস, এসে পড়ল গলায়। কয়েকটা হেচকা টানে চোখে শর্ষে ফুল দেখতে দেখতে ডাঙায় এসে ঠেকল রানার দেহ। প্রথমেই ওর হাত দুটো পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে চুপচুপে ভেজা শোল্ডার-হোলস্টার থেকে বের করে নেয়া হলো পিস্তলটা।
আবদুলকেও একই উপায়ে টেনে আনা হলো–কিন্তু বন্দি হবার আগেই বিদ্যুৎগতিতে কোমর থেকে ছোরা বের করে আমূল বসিয়ে দিল সে সামনের লোকটার বুকের মধ্যে। তীক্ষ্ণ একটা অপার্থিব চিৎকার করে পড়ে গেল লোকটা পানিতে। ততক্ষণে ছুরিটা টেনে বের করে নিয়ে আবদুল পাশের লোকটার কাকালে বসাতে যাবে, এমন সময় গর্জে উঠল একটা সাব-মেশিনগান।
তিন সেকেণ্ড একটানা বিশ্রী শব্দ বেরোল ওটা থেকে। করডাইটের উৎকট গন্ধ এল নাকে।
চালনির মত ফুটো ফুটো ঝাঁঝরা হয়ে গেল আবদুলের প্রশস্ত বুক। অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক। লুটিয়ে পড়ল রানার পায়ের কাছে ওর নিঃসাড়, প্রাণহীন দেহটা।
এবার ধীরে ধীরে সাব-মেশিনগানের মুখটা ফিরল রানার দিকে। অল্পঅল্প। ধোঁয়া বেরোচ্ছে সেটার মুখ থেকে। লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে যেন রানার বুকের দিকে।
চারদিকে অথৈ জল, আকাশে শুক্লা এয়োদশী, আর সেই সঙ্গে মৃদু-মন্দ জোলো হাওয়া।
নিজেকে বড় অসহায় মনে হলো রানার।
৮
নিশ্চিত মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করছে রানা। আবদুলের কথা ভাববার সময় তখন নয়, তবু নিজেকে মস্তবড় অপরাধী মনে হলো। ওর এই আকস্মিক নির্মম মৃত্যুর জন্যে মনে মনে নিজেকেই দায়ী করল রানা। এই মৃত্যুর ফাঁদে কেন ও আনতে গেল ওকে! কবীর চৌধুরীর ভয়ঙ্কর রূপ কি ও চিটাগাঙে-এই দেখেনি? তবু আজ এ দুঃসাহস করতে গেল কেন সে? আরও অনেক ভাবনা চিন্তা করে অনেক সাবধানে পা বাড়ানো উচিত ছিল ওর। একটু পরেই লুটিয়ে পড়বে ওর প্রাণহীন দেহটা আবদুলের পাশে। তেমনি এক তীক্ষ্ণ মরণ চিৎকার বেরিয়ে আসবে ওর মুখ। দিয়েও। কিন্তু এ মৃত্যুতে লাভ তো কিছুই হলো না। রাহাত খান শুনলে কাঁচা পাকা ভুরু জোড়া কুঁচকে বলবেন, ‘ফুলিশ’। মেশিনগানধারীর উদ্দেশে মনে মনে বলল, জলদি কর, হারামজাদা, দেরি করছিস কেন, যা করবি কর তাড়াতাড়ি!
‘চলো, আগে বাড়ো।’ ঠেলা দিল পিছনের লোকটা।
সামনের লোকটাও এবার মেশিনগানের মাথাটা দিয়ে ডান দিকে ইঙ্গিত করল। কোনও রকম শয়তানির চেষ্টা করলে ওই নির্বোধ পাঠানের অবস্থা হবে। তোমারও। সাবধান!
দুই পা এগিয়ে থামল রানা। ঘুরে দাঁড়াল আবদুলের দিকে মুখ করে। মৃতদেহটার দিকে চেয়ে মনে মনে বলল, তোমার মৃত্যুর প্রতিশোধ আমি নেব আবদুল, প্রতিজ্ঞা করলাম। তারপর এগিয়ে গেল সামনে।
টিলার মাথায় সযত্নে ঘাস আর উলুখাগড়া লাগানো বেশ খানিকটা অংশ নিচু হয়ে সরে গেল এক পাশে। সিঁড়ি নেমে গেছে ভিতরে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে। উজ্জ্বল না হলেও স্বচ্ছ আলোয় আলোকিত ভিতরটা। পাক খেয়ে খেয়ে সতেরো-আঠারো ধাপ নামার পর একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল রানা। দুভাগ হয়ে সরে গেল। দরজাটা দুপাশের দেয়ালের মধ্যে। সামনে প্রশস্ত একটা চারকোণা ঘর। জানালা। নেই একটাও, শুধু চার দেয়ালের গায়ে বড় বড় চারটে দরজা।