হাজুর, বিপোদ হামি ডোর পায় না; হামি সঙ্গে থাকলে হোত আসানি হোবে আপনার-পাহাড়ে পাহাড়ে আট বোচ্ছোর চলসি আমি।’
ওসি-ও আবদুলের কথায় সায় দিল। যে-কোনও বিপজ্জনক কাজে যেতে এই আবদুলের খোঁজ পড়ে সব সময়। শেষ পর্যন্ত আবদুলের একান্ত অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারল না রানা। ওকেও নিতে হলো সঙ্গে।
আবদুলের কথার সত্যতা প্রমাণ হলো পাহাড়ে কিছুদূর চলেই। দিনের বেলা হয়তো কষ্টে-সৃষ্টে আছড়ে-পাছড়ে এই পাহাড়ি পথে চলা রানার পক্ষে অসম্ভব হত না, কিন্তু আবদুল না থাকলে এই রাতে সত্যিই চোখে আঁধার দেখত সে। ঝোঁপ ঝাড় আর কাঁটার মধ্য দিয়ে গা বাঁচিয়ে একটার পর একটা উঁচু-নিচু টিলা পার হয়ে চলল ওরা। মাঝে মাঝে বন্য জন্তু জানোয়ারের তৈরি পথ পেয়ে যাচ্ছে ওরা-কিছুদূর ভালই চলছে, কিন্তু আবার টেলিভিশন তারটাকে অনুসরণ করতে গিয়ে বিপথে চলতে হচ্ছে ওদেরকে। দুর্গম গোটা কতক খাড়াইয়ে আবদুল আগে উঠে গিয়ে টেনে তুলল রানাকে।
মাঝে মাঝে টর্চ জ্বেলে টেলিভিশনের তার দেখে নিচ্ছে ওরা। হঠাৎ ছুরি বের করল আবদুল। পিছন ফিরে কানে কানে রানাকে বলল, ‘পিস্তোল থাকলে রেডি হয়ে যান, হাজুর, কী জানি আইতেছে এদিকে!
দাঁড়িয়ে পড়ল ওরা। আধ মিনিট পর রানা শুনতে পেল সামনের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে কিছু একটা এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। আবদুলের অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ শ্রবণশক্তির প্রমাণ আগেই পেয়েছিল রানা লারসেনের অফিসে, তাই ওর এত আগে থেকে সাবধান হয়ে যাওয়ায় বিস্মিত হলো না। শব্দটা কীসের ঠিক বোঝাও গেল না। হাত দশেক সামনে এসে থমকে থাকল দুতিন সেকেণ্ড, তারপর ডান দিকে চলে গেল শুকনো পাতার ওপর দিয়ে মচ মচ শব্দ তুলে। কোনও বন্য জানোয়ার হবে।
এদিকে বাঘ-টাঘ আছে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘আছে, হাজুর।
টর্চ জ্বাললে মাঝে মাঝে ওদের সচকিত করে দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে ছোট ছোট ভিতু খরগোশ কিংবা শিয়াল। ওরা থামলেই শুনতে পায় আশপাশে সাবধানী পদক্ষেপ। রানার মনে হলো সবাই যেন নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে ওদের পিছন পিছন আসছে। হঠাৎ এক-আধটা প্যাঁচা ডেকে উঠছে। অশুভ ইঙ্গিত। ছমছম করে ওঠে গা।
একটা ঠাণ্ডা ভেজা দমকা হাওয়া আসতেই দুজন একসঙ্গে চাইল আকাশের দিকে। পুব দিকে পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু পশ্চিমের আকাশ ঘন অন্ধকার। আসছে কালবৈশাখীর ঝড়।
একটু পরেই ঝড় উঠল–তার অল্পক্ষণ পর শুরু হলো বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি। চাঁদটা মেঘে ঢাকা পড়তেই চার দিকটা সূচীভেদ্য অন্ধকার হয়ে গেল। বড় একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাল রানা। ঠাস ঠাস ডাল ভেঙে হুড়মুড় করে পড়ছে এদিক ওদিকে। রানার রিস্টওয়াচে বাজে সাড়ে আটটা।
না, আবদুল। আর অপেক্ষা করা চলে না, এরই মধ্য দিয়ে এগোতে হবে। আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে মনস্থির করে ফেলল রানা।
এবার পথ চলা আরও দুঃসাধ্য হয়ে উঠল। পাহাড়ি আঠালো মাটি পিচ্ছিল হয়ে গেছে বৃষ্টির পানিতে। এক জায়গায় পা ফেললে অন্য জায়গায় চলে যেতে চায় সেটা। তার উপর দমকা ঝোড়ো হাওয়া এক ইঞ্চিও এগোতে দিতে চায় না।
উঁচু পাহাড়ের গায়ে গভীর খাদ। তারই পাশ দিয়ে যেতে হবে প্রায় গজ বিশেক। একটু পা ফসকালে একেবারে দু’তিন শ’ গজ নীচে গিয়ে পড়তে হবে। অর্থাৎ একেবারে ছাতু। খুব সাবধানে পা টিপে টিপে এগোল ওরা। কিন্তু সাবধানেরও মার আছে। হঠাৎ পা পিছলে গেল রানার। এক হাতে পাহাড়ের গা থেকে বেরিয়ে আসা একটা শিকড় ধরল রানা, কিন্তু তা-ও গেল ছিঁড়ে। চট করে ওর একটা হাত ধরে ফেলল আবদুল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজেও গেল পিছলে। সড় সড় করে হাত ধরাধরি করে দুজন পনেরো ফুট নেমে এসে একটা গাছের গুঁড়িতে আটকে গেল। ঠিক সময় মত আবদুল ধরে ফেলতে না পারলে একেবারে খাদের নীচে গিয়ে পড়ত রানা।
‘চোট তো লাগে নাই, হাজুর!’
মৃদু হেসে রানা ভাবল, একেই আমি সন্দেহ করেছিলাম। মনে করেছিলাম, ইসলাম না হয়ে এ-ও সেই লোকটাকে খুন করে থাকতে পারে পানির তলায়!
তিন মাইল এভাবে চলবার পর দেখা গেল সত্যিই পানির মধ্যে চলে গেছে। তারটা। বোঝা গেল, আর খুব বেশি দূরে নেই গন্তব্যস্থল।
পানিতে নেমে পড়ল দুজন। কোয়ার্টার মাইলটাক তার ধরে এগোবার পর সামনে একটা উঁচু পাহাড় দেখা গেল। বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ। ছোট-বড় কালো-সাদা হরেক রকমের মেঘ মাঝে মাঝে চাঁদটাকে আড়াল করছে। যেই হাওয়ায় ভেসে সরে যাচ্ছে মেঘগুলো, অমনি আবার ফিক করে হেসে উঠছে চাঁদ, ছোট ছোট ঢেউগুলোর মাথায় ঝিলমিল করছে তার আলো। পাহাড়টার কাছাকাছি আসতেই রানা দেখল পানির নীচে একটা লোহার পোস্ট পোতা। সেখানে এসে তারটা পোস্টের মধ্যে ঢুকেছে। পোস্টের চারদিকে হাতড়ে আবার তারটা পাওয়া গেল-সোজা চলে গেছে পাহাড়টার দিকে।
এগোতে গিয়েও কী মনে করে থেমে গেল রানা। আবদুলকে একটু অপেক্ষা করতে বলে দু’হাতে পোস্টটাকে বেষ্টন করে ডুব দিল। একটু পরেই হাত দশেক বাঁয়ে ভেসে উঠল সে। ফিরে এসে পোস্টটা আঁকড়ে ধরে বিশ্রাম নিল ও আধ মিনিট, তারপর বলল, ‘আমাদের বাঁ দিকে যেতে হবে, আবদুল।’
‘কেন, হাজুর, তার তো গেছে ওই পাহাড়টার দিকে।
‘ওটা একটা ভাঁওতা। ওটা অন্য তার। আসল তার এই থামের দশ ফুট নীচ দিয়ে বেরিয়ে বাম দিকে চলে গেছে। সামনের তার ধরে গেলে কিছুই পাওয়া যাবে না।