চৌধুরী এখন কোথায়, সে প্রশ্নের উত্তরে হাই বলল, সে গা ঢাকা দিয়েছে। সারা চিটাগাং শহরে ওর চিহ্নমাত্র নেই। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে খোঁজ নিয়ে দেখা। গেছে যে কোথাও ওর নামে এক আঁচড় কালির দাগও নেই। তবে একবার মোটর পার্টস ইমপোর্ট করবার লাইসেন্স দিয়ে সে অদ্ভুত কতগুলো যন্ত্র…
কথা শেষ হবার আগেই টেলিফোনের কানেকশন কেটে গেল। কিছুক্ষণ। বিভিন্ন রকমের শব্দ হওয়ার পর নীরব হয়ে গেল রিসিভার।
এমনি সময়ে ঘরে ঢুকল আবদুল।
‘পেলে কিছু? লারসেন সাহেবই প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন।
না, হুজুর। ওই তিন জায়গায় না পেয়ে তামাম বাঁধ চষে ফেলেছি আমরা কয়জন! কোথাও কিছু নেই। আর থাকলেও, হাজুর, বুঝবার উপায় নেই। উর্দু ইংরেজিতে মিশিয়ে বলল ভগ্নমনোরথ আবদুল নিরুৎসাহিত কণ্ঠে।
‘আচ্ছা, আবদুল, তুমি তো এই অঞ্চল খুব ভাল করে চেনো। কবীর চৌধুরী বলে কারও নাম শুনেছ কখনও?’ রানা জিজ্ঞেস করল।
না, হাজুর, এ নাম শুনিনি। দেখলে হয়তো চিনতে পারি।’
‘রাঙামাটি এখান থেকে কতদূর?
‘তেরো মাইল।
তা হলে কাপ্তাই থেকে পাঁচ-ছয় মাইল উত্তর-পশ্চিমে মাইল দুয়েক জায়গা কিনে নিয়ে একজন লোক…
‘হাঁ, হাজুর! পাগলা এক লোগ ছিল সেখানে। একট টেঙরি ল্যাংড়া ছিল। একবার বোড়ো দাবড়ি লাগাইছিল আমাদের। শিকারে গিয়ে…’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। সে-ই লোকই কবীর চৌধুরী। রাতের বেলায় সেই জায়গাটা চিনতে পারবে তুমি প্রয়োজন হলে?
‘ইনশাল্লাহ। কিন্তু সে সব জমিন তো পানির নীচে চলে গেছে, হাজুর।’
‘এক আধটাও উঁচু টিলা কি নেই, যেখানে এখনও পানি ওঠেনি?’
মি. লারসেন মাঝখান থেকে প্রশ্ন করলেন, আপনি কি মনে করেন এক আধটা টিলা যদি পানির ওপর মাথা তুলে থাকেই, সেখানে এখনও আস্তানা আছে লোকটার?
‘তা ঠিক নিশ্চিত করে বলতে পারছি না, তবে আমার সেই রকমই সন্দেহ। মোটরবোটে যখন সে এখানে লোক পাঠাচ্ছে, তখন এ সন্দেহটা একেবারে অমূলক নয়।’
রানা ভাবছিল, দুটো মাত্র উপায় আছে। এক, ডিনামাইট খুঁজে বের করে অকেজো করে দেয়া। দুই, চৌধুরীর আড্ডা বের করে ওটা ফাটানোয় বাধা দেয়া।
ডিনামাইট তো তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেল না। সেটা পাওয়া গেলে হাতে কিছু সময় পাওয়া যেত। এখন যে কোনও মুহূর্তে সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। তাই যে করেই হোক চৌধুরীর আস্তানা বের করা চাই-ই চাই। এবং আজই রাত্রে। একমাত্র ভরসা টেলিভিশন ক্যামেরার তার। দেখা যাক, কী। দাঁড়ায়। মনের উত্তেজনাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করল সে।
রেস্ট হাউসে ফিরে রানা দেখল ঘর খালি। বাথরুমের দরজাও খোলা হাঁ করা। সুলতা নেই। গেল কোথায়! একই মুহূর্তে অনেক চিন্তা ছুটোছুটি করল। রানার মাথার মধ্যে। ছুটে এসে ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করল। কেউ কিছুই বলতে পারল না। কেউ দেখেনি সুলতাকে বেরিয়ে যেতে।
মনে মনে একটা বিষণ্ণ হাসি হাসল রানা। চলে গেছে সুলতা। যাবার আগে অমন অভিনয় না করলেও তো পারত! ঘরটা একেবারে খালি খালি লাগল রানার কাছে। জোর করে মাথা থেকে সব চিন্তা দূর করে শুয়ে পড়ল ও বিছানায় গিয়ে। বিশ্রাম দরকার।
জানতেও পারল না রানা মাত্র একশো গজ দূরে একটা খালি বাড়ির গ্যারেজের মধ্যে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে অসহায় সুলতা রায়।
ঠিক সাড়ে ছ’টায় এসপি সাহেব এসে ঘুম ভাঙালেন রানার। তারের শেষ মাথা পাওয়া গেল? প্রশ্ন করল উদগ্রীব রানা।
নাহ্। মাইল পাঁচেক রাস্তার পাশ দিয়ে গিয়ে তারটা চলে গেছে ডানধারে দুর্গম পাহাড়ের ওপর দিয়ে। আমাদের লোক সেই পাহাড় ডিঙিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত গিয়েছিল কিন্তু তারের শেষ আর পায়নি। পানির মধ্যে চলে গেছে তারটা। ওখান থেকেই ফিরে এসেছে ওরা।’
‘সন্ধ্যার পর ঠিক যেখানে তারটা পাহাড়ের ওপর দিয়ে গেছে, সেই রাস্তায়
আমাকে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারবেন, মি, হক?’
‘নিশ্চয়ই, এ আর এমন কী কথা হলো?– হাত-মুখ ধুয়ে নিল রানা। চা খেতে খেতে এসপি সাহেব বলেই ফেললেন, হঠাৎ কী আরম্ভ হয়ে গেল কাপ্তাইয়ে, মি, রানা? কিছুই বুঝতে পারছি না। ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলবেন?
সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে নিয়ে সংক্ষেপে বলল রানা সব কথা।
‘তা হলে তো থানায় ফিরে যাওয়া নিরাপদ নয়। পানির লেভেলের অনেক নীচে ফাড়িটা-আমার কোয়ার্টারও নীচে। যে কোনও মুহূর্তে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে আমাদের!’ শঙ্কিত এসপি বেসামাল হয়ে পড়লেন সব শুনে,
‘আপনি কেবল নিজের কথাই ভাবছেন। লক্ষ লক্ষ মানুষের কী অবস্থা হবে ভাবুন একবার। আর কাল যদি প্রেসিডেন্ট পৌঁছবার পর পরই বাধটা ভাঙে, তা হলে?’.
‘ভয়ঙ্কর, মি. রানা! সাঙ্ঘাতিক, প্রলয়ঙ্কর ব্যাপার! এখন লোকটাকে বাধা দেবার জন্যে কী করতে চান? পুলিশ ফোর্স দেব আপনার সঙ্গে?
‘তাতে কোনও লাভ হবে না। সতর্ক হয়ে গেলেই পালিয়ে যাবে কবীর চৌধুরী ওর আস্তানা থেকে। তারপর যে কোনওখান থেকেই রেডিয়ো ট্রান্সমিটার দিয়ে উড়িয়ে দেবে এ বাঁধ। ওকে কোনও উপায়ে আচমকা অপ্রস্তুত অবস্থায় ধরতে হবে। ফোর্স নিয়ে গিয়ে লাভ নেই-আমি একা যাব।
আবদুল এসে দাঁড়াল। রানা তখন জিপে উঠে বসেছে।
‘আমিও যাব, হাজুর! আবদুলের কণ্ঠে অনুনয়।
যে কোনও ভয়ানক বিপদ ঘটতে পারে, আবদুল। তুমি থাকো, একাই যাব আমি।’