‘ধরা পড়বার আগে তোমাকে শেষ করে দিয়ে যাব, মাসুদ রানা। মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হয়ে নাও।
মৃদু হেসে রানা বলল, আমি প্রস্তুত। মারো।’
বাধা দেয়ার চেষ্টা করছ না কেন?’ বিস্মিত হয় সুলতা।
‘আমি দুর্বল, তাই।’
কিছুক্ষণ সমস্ত ইচ্ছাশক্তি একত্রিত করেও যখন ট্রিগার টিপতে পারল না সুলতা তখন একটু হেসে রানা বলল, ‘সেফটি ক্যাচটা অফ করে নাও।
কয়েক মুহূর্ত পাগলের মত উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে রানার চোখে চোখে চেয়ে থেকে পিস্তলটা ছুঁড়ে ফেলে দিল সুলতা। তারপর জানালার কাছে গিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
আরও পাঁচ মিনিট কেটে গেল নিঃশব্দে।
‘লতা!’ মনটা স্থির করে ডাকল রানা।
বলো। নির্বিকার কণ্ঠ সুলতার।
‘তোমার কাছে কেউ এসেছিল?
হ্যাঁ।
‘নিরাপদে কলকাতায় পৌঁছে দেয়ার কথা বলেছিল?
হ্যাঁ।
‘আমি বেরিয়ে গেলেই আবার সে আসবে, তাই না?
চুপ করে থাকল সুলতা। মৃদু হেসে রানা বলল, ‘আজ বিদায়ের ক্ষণে আর অবিশ্বাস না-ই বা করলে, লতা।’
রানার কণ্ঠে এমন একটা আন্তরিক আকুতি ছিল যে বিস্মিত সুলতা কিছুক্ষণ ওর চোখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, ‘আসবে।’
তুমি তার সঙ্গে চলে যেয়ো, লতা। কেউ তোমাকে বাধা দেবে না। তোমার সুটকেস যাতে তুমি ফিরে পাও সে ব্যবস্থাও আমি করব, কথা দিচ্ছি।’
‘আমাকে শত্রুপক্ষের গুপ্তচর জেনেও ছেড়ে দেবে?’ ঠিক বিশ্বাস করতে ভরসা হচ্ছে না সুলতার।
হ্যাঁ, ছেড়ে দেব। তোমাকে আটকে রাখায় পাকিস্তানের কোনও লাভ নেই। তোমার কাছে এমন কোনও তথ্য নেই যাতে পাকিস্তানের কোনও উপকার হতে পারে। তাই তোমাকে মুক্তি দেব। অবশ্য নিজের ইচ্ছে মত তোমাকে ছেড়ে দেয়ায় আমাকে জবাবদিহি করতে হবে-হয়তো সাসপেণ্ডও করতে পারে কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। তুমি চলে যাও, লতা। তোমাকে আমি নিরাপদে চলে। যাওয়ার সুযোগ দেব।’
‘আর কিছু বলবে?
হ্যাঁ। আর একটা ছোট্ট, সাধারণ অথচ অবিশ্বাস্য কথা বলব। কলকাতায় ফিরে গিয়ে কথাটা মনে পড়লে হাসি আসবে তোমার। তোমার কাছে এর কোনও মূল্য নেই বলেই হয়তো চিরকাল এটা অমূল্য হয়ে থাকবে আমার কাছে। তোমার সঙ্গে শুধুমাত্র অভিনয়ই করিনি আমি, লতা। কথাটা বিশ্বাস করো।’
কথাটা শেষ করেই দ্রুত লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে যাচ্ছিল রানা ঘর থেকে, হঠাৎ জামার হাতায় টান পড়ল। ঘুরে দেখল সুলতা।
যদি আমি না যাই।’
যাবে না কেন?’
যাব না-ই তো! আমিও তো তোমায় ভালবেসেছি, রানা! তোমার সন্তান আমি কামনা করেছি আমার গর্ভে। মাথাটা নিচু করল সুলতা একটু।
‘সে তো সুবীর সেন মনে করে!
যদি বলি যাকে মন দিয়েছি তার নাম সুবীর হোক বা রানা হোক কিছুই এসে যায় না, মানুষটা সে একই-তবে তার পাশে চিরদিনের মত একটু স্থান পাব?’
‘পাবে, বিনা দ্বিধায় জবাব দিল রানা।
‘আমার সব কলঙ্কের কথা জেনেও আমাকে গ্রহণ করবে তুমি? ঘৃণা করবে?’
কলঙ্ক তো চাঁদের অলঙ্কার।’
ঝাঁপিয়ে পড়ল সুলতা রানার বুকের ওপর। দু’হাতে জড়িয়ে ধরল রানা। ওকে। ব্যবধান রইল না আর। রানার বুকের ওপর মাথা রেখে পরম নিশ্চিন্তে। কাঁদছে সুলতা। আলতো করে চুমো দিল রানা ওর কপালে।
.
‘এক্ষুণি একবার থানায় আসতে পারবেন, মি. মাসুদ? আমি আতাউল হক, এসপি চিটাগাং বলছি। আমি স্পেশাল ডিউটিতে কাপ্তাইয়ে আছি। টেলিফোনে গলাটা, একটু উত্তেজিত শোনাল।
এঁর সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় ছিল রানার। চিনতে পারল গলার স্বর এবং সিলেটি উচ্চারণ।
আসতে পারি। কিন্তু ব্যাপার কী?
‘আপনার কথামত লোক পাঠিয়েছিলাম। সেই চক্চকে তারটার এই মাথায় একটা ক্যামেরা বসানো আছে। আশ্চর্য ব্যাপার! শিগগির চলে আসুন, নিজ চোখে দেখবেন।
‘আমি এক্ষুণি আসছি।’
‘আরও একটা খবর, হ্যালো, হ্যালো…’
বলুন, ধরেই আছি। রিস্টওয়াচটা দেখল একবার রানা।
‘এই কিছুক্ষণ আগে যাকে হ্যাণ্ডওভার করলেন ওসি-র কাছে, সেই মতিনকে মেরে ফেলেছে ওরা গুলি করে। থানায় এনে যেই জিপ থেকে নামানো হয়েছে। অমনি একটা গুলি এসে লাগল একেবারে হৃৎপিণ্ডে। এক গুলিতেই শেষ। কোনও আওয়াজ পাওয়া যায়নি বন্দুকের। খুব সম্ভব সাইলেন্সর লাগানো টেলিস্কোপ লাগানো রাইফেল দিয়ে মেরেছে বহু দূর থেকে। আপনি গাড়ি নিয়ে একেবারে ভেতর চলে আসবেন দালানটা ঘুরে থানার পেছন দিক দিয়ে। গাড়ি-বারান্দায় গাড়ি থেকে নামবেন না। রাখি, আপনি চলে আসেন।’
.
ইউএসএ-র জেনারেল প্রিসিশন ইনকর্পোরেটেড-এর তৈরি শক্তিশালী সিসিটিভি ক্যামেরা। একটা টিলার গায়ে জঙ্গলের মধ্যে বাঁধের দিকে মুখ করে বসানো। রোদ-বৃষ্টি থেকে আড়াল করবার জন্য, এবং কিছুটা ক্যামোফ্লেজের উদ্দেশ্যে লেন্স ছাড়া বাকি সব সবুজ প্লাস্টিক দিয়ে ঢাকা।
‘এ তারের আরেক মাথা কোথায় গেছে বের করা দরকার, রানা বলল।
‘জিপ দিয়ে অনেক আগেই লোক পাঠিয়ে দিয়েছি। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আশা করি ফিরে আসবে খবর নিয়ে,’ জবাব দিলেন আতাউল হক।
‘গোপনীয়তার ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছেন তো!
হ্যাঁ। বলে দিয়েছি দূর থেকে দেখেই যেন ফিরে আসে।
ভাল করেছেন। খবরটা এলেই যেন আমি পাই সে ব্যবস্থা করবেন দয়া করে। আমি যাচ্ছি এখন মি. লারসেনের অফিসে।
লারসেনের অফিস থেকেই চিটাগাং-এ আবদুল হাইয়ের কাছে ফোন করল রানা। কিন্তু আসল কথাটাই জানা গেল না। কবীর চৌধুরীর গোপন আস্তানা বের করতে পারেনি আবদুল হাই। কেউ নাকি বলতে পারে না। এইটুকু কেবল জানা গেল, রাঙামাটির সাত-আট মাইল দক্ষিণে প্রায় দুই বর্গমাইল জায়গা কিনে নিয়েছিল কবীর চৌধুরী আট-দশ বছর আগে। এখন সব চলে গেছে রিজার ভয়েরের পানির তলায়। ওখানে কোনও আস্তানা থাকবার প্রশ্নই উঠতে পারে না।