‘লিম্পেট মাইন?
‘আমার মনে হয় ও জিনিসটা জাহাজের জন্যই উপযুক্ত। এখানে ওরা হাই পাওয়ার্ড টিএনটি ব্যবহার করছে। দূর থেকে রেডিয়ো ট্রান্সমিশনের সাহায্যে ফাটানো হবে ওগুলো।
‘মাই গুডনেস! কখন?’ আবার কথার মধ্যে বাধা দিয়ে প্রশ্ন করলেন মি. লারসেন।
‘তা-ও আমার জানা নেই। এখন থেকে যে কোনও মুহূর্তে ফাটতে পারে। আমি এক সুযোগে ওদের নক্সাটা দেখে নিয়ে মুখস্থ করে ফেলি। এই বাঁধ কতখানি লম্বা তা আমার জানা নেই। আমি শুধু হুবহু ছবিটা এঁকে লাল চিহ্ন দিয়ে দেব তিনটে জায়গায়। আপনি হিসেব করে ঠিক ঠিক জায়গাগুলো বের করে নিয়ে জনাদশেক বিশ্বস্ত ডুবুরী নামিয়ে তন্নতন্ন করে খোঁজাবেন সে জায়গা।
‘তা না হয় করলাম। কিন্তু পুলিশে খবর দিচ্ছেন না কেন? লোকটাকে ধরতে পারলেই তো সব গোলমাল চুকে যায়। জানেন, এটা কতখানি সিরিয়াস ব্যাপার? এই ড্যাম এখন ভাঙলে-ওহ, জিস! গোটা চিটাগাং ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে যাবে। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না, মি. রানা, কত লক্ষ লক্ষ লোক মারা যাবে। সামুদ্রিক ঘূণি ঝড় এর কাছে কী? একটা লোকও তো বাঁচবে না এই ভয়ঙ্কর বন্যার হাত থেকে!
সবই জানি। কিন্তু পুলিশকে জানিয়ে এখন কোনও লাভ নেই। লোকটার। আস্তানা কেউ জানে না। একটা গভীর চক্রান্ত দানা বেঁধেছে এই বাধকে ঘিরে। আপনাকে বলেছিলাম, এক কাজে এসে এখানে অন্য ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছি; কিন্তু এখন দেখছি দুটো ব্যাপারই এক। যাক, এখন একটা চক বা মোটা শিষের। লাল-নীল পেন্সিল দিন, আমি মেঝেতে ছবিটা এঁকে দিয়ে যাই।
বাম দিকের চিহ্নটা দেখে আবদুল বলল, এই জায়গাটাই তো আপনাকে এখন দেখিয়ে আনলাম! এখন সোব কথা আমি বুঝতে পারছি, হাজুর। মাঝখানের ওই লাল দাগটাতেই আমি পরথম দিন ভুড়ভুড়ি দেখছিলাম!’
লারসেনের একান্ত অনুরোধে আজকের দিনের জন্য তাঁর গাড়িটা ব্যবহার। করতে রাজি হলো রানা। সোয়া একটা বাজে তখন। চাদি ফাটানো কড়া রোদ উঠেছে। লারসেনের এয়ার-কুলড ঠাণ্ডা অফিস থেকে বেরিয়ে এসেই অসম্ভব গরম লাগল রানার। চিটপিট করে উঠল পিঠটা। বিকেলের দিকে ঝড় উঠতে পারে।
দুপুরেই উঠল সে ঝড় সুলতার মনে।
‘তোমার গাড়ি কী হলো?’ সুলতা এগিয়ে এল রানাকে দেখে।
‘টাই-বম্ব দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে কবীর চৌধুরী।
সুলতা ভাবল, একটু আগে যে লোকটা এসেছিল সে তা হলে সত্যি কথাই বলেছে! সে অবশ্য বলেছিল মাসুদ রানাও ছাতু হয়ে যাবে সেই সঙ্গে।
‘তোমার কিছু হয়নি?
‘আমি তখন এই গাড়িতে ছিলাম। কিন্তু কী ব্যাপার, সুলতা-তোমার চোখ মুখ এমন মলিন কেন? কী হয়েছে? উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে রানা।
‘একটা কথা সত্যি করে বলবে?
তীক্ষ দৃষ্টিতে সুলতার মুখের দিকে চেয়ে অনেকখানি বুঝে ফেলল রানা ওর মনের কথা। মৃদু হেসে বলল, ‘বলব।’
‘তোমার সত্যিকার পরিচয় কী?
‘আমি পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের একজন এজেন্ট, মাসুদ রানা।
দুই হাতে নিজের দুই কান বন্ধ করল সুলতা। একথা সৈ শুনতে চায় না! একথা ও বিশ্বাস করে না! না, না, এ হতেই পারে না! এ হতেই পারে না! ও মাসুদ রানা নয়, ও সুবীর, আমার সুবীর!
‘টেলিগ্রামটা দেখি। গলাটা একটু ভেঙে আসে সুলতার।
পকেট থেকে বের করে দিল রানা সে টেলিগ্রাম। সুলতা পড়ল:
সেন সিক অ্যাট ঢাকা স্টপ নেগোসিয়েশন ব্রেক ডাউন স্টপ ক্লোজ উইথ নিউ কোম্পানি স্টপ ফর সলভেনসি রেফার চৌধুরী।
কয়েকবার লেখাগুলোর উপর চোখ বুলাল সুলতা। ধীরে ধীরে অক্ষরগুলো সব এলোমেলো ঘোলাটে হয়ে গেল। টপ টপ করে কয়েক ফোঁটা জল ঝরে পড়ল টেলিগ্রামটার উপর। তারপর ছিঁড়ে কুটিকুটি করে দুমড়ে মুচড়ে দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল কাগজটা জানালা দিয়ে বাইরে।
তুমি এভাবে আমাকে প্রতারণা করলে কেন?’ আহত সাপিনীর মত চাপা গর্জন করে উঠল সুলতা, বললো, কেন আমাকে প্রতারণা করলে তুমি!
‘এজন্যেই আমাকে পাঠানো হয়েছে, সুলতা। তোমাকেও পাঠানো হয়েছে। আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করতে, এদেশের ভয়ঙ্কর একটা ক্ষতি করতে।… আমি আমার সরকারের হুকুম তামিল করেছি মাত্র।’
কিছু খেল না সুলতা। কখনও কি স্বপ্নেও ভেবেছিল এতবড় আঘাত পাবে সে? যাকে ভালবেসে মনে হয়েছে ধন্য হলাম, পরিপূর্ণ হলাম…যাকে বিশ্বাস করে। দেহমন সঁপে দিলাম পরম নিশ্চিন্ত নির্ভরতায়, সে বলছে: আমি অফিসের হুকুমে তোমার সঙ্গে অভিনয় করেছি মাত্র। এখন প্রয়োজন ফুরিয়েছে, নিশ্চয়ই এবার তাকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেবে মাসুদ রানা। কথাটা মনে হতেই শিউরে উঠল সুলতা। নয়া দিল্লীতে প্রথম যখন চাকরিতে যোগ দিল তখন থেকেই এই নাম। শুনে আসছে সে। মাসুদ রানার নামে আলাদা একটা মোটা ফাইলে নিত্য নতুন রিপোর্ট সে নিজ হাতে গেঁথে রেখেছে। লাল ফিতে বাঁধা সেই ফাইলটা এখনও চোখে ভাসে সুলতার। কতদিন পাতা উল্টিয়ে পড়েছে সে এর ভয়ঙ্কর, দুর্ধর্ষ, রোমহর্ষক কার্যকলাপের বিবরণ। অদ্ভুত কৌশলী, বুদ্ধিমান এবং দৃঢ়চেতা এই যুবককে তাদের সার্ভিসের কে না ভীতির চোখে দেখে? আজ ভুল করে এরই প্রেমে পড়ে মরণ হবে সুলতার কে ভাবতে পেরেছিল?
রানারও খাওয়া হলো না কিছুই। একটা সোফায় বসে চোখ বন্ধ করে মাথাটা এলিয়ে দিল ও পিছন দিকে। ভাবছিল, এল বিদায়ের পালা। কতটুকুই আর চিনি। একে-কাল দুপুর থেকে আজ দুপুর-চব্বিশ ঘণ্টাও হয়নি। কিন্তু মনে হচ্ছে যেন কত যুগের পরিচয়, জন্ম-জন্মান্তরের বন্ধুত্ব। একে বিদায় দিতে হৃদয়টা আজ এমনি করে পুড়ছে কেন? ( চোখ বন্ধ করেও মানুষ দেখতে পায়। অস্পষ্ট একটা ছায়া দেখে ধীরে ধীরে চোখ মেলল রানা। দেখল তার কপাল থেকে ছয় ইঞ্চি দূরে সুলতার হাতে ধরা অ্যাট্রা পিস্তলটা লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওর দিকে।