এক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল চৌধুরী, না, ফিরে চলে এসো এক্ষুণি।’
চিন্তিত মুখে আবার কী-বোর্ডে কিছুক্ষণ আঙুল চালিয়ে বলল, ‘এক্স ওয়াই জেড কলিং কে পি ফাইভ, এক্স ওয়াই জেড কলিং কে পি ফাইভ, এক্স ওয়াই জেড কলিং কে পি ফাইভ। ক্যান ইউ হিয়ার মি? বার কয়েক কথাটা উচ্চারণ করল সে। তারপর উত্তর এল।
‘দিস ইজ কে পি ফাইভ। হিয়ার ইউ লাউড অ্যাণ্ড ক্লিয়ার, স্যর। কাপ্তাই ভিআইপি রেস্ট হাউসের একটা কামরায় ওয়াকি টকির সামনে বসে শুনছে কে পি ফাইভ।
‘ড্যামের গায়ে আনলাকি থারটিন কাজ করছে, মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ধরা পড়বে ও। তুমি গিয়ে পানিতে নামবে সবার আগে। যন্ত্রপাতি মাটি চাপা দিয়ে দেবে এবং তেরো নম্বরের মৃতদেহ নিয়ে ওপরে উঠবে। বুঝতে পেরেছ? তেরো। যেন জ্যান্ত পানির ওপর না ওঠে।’
বুঝেছি, স্যর, যাচ্ছি এখুনি।
.
সিক্সটি মডেলের একটা কালো শেভ্রোলে আইইকো-চীফ মি. লারসেনের পাশে এসে থামল জোরে ব্রেক কষে। জানালা দিয়ে মুখটা বের করে আরোহী বলল, ‘হ্যালো, লারসেন, কী করছ এখানে?
হ্যাল্লো, ইসলাম। তুমি কোত্থেকে? নেমে এসো, একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস দেখাচ্ছি তোমাকে।
কী ব্যাপার?’ বলে নেমে এল গাড়ি থেকে রাফিকুল ইসলাম। অফিসারস ক্লাবের হিরো এই ইসলাম। ক্লাবে মোটা স্টেকে ব্রিজ, ফ্ল্যাশ, পোকার খেলে এবং প্রতিবার প্রচুর টাকা হেরে, মাঝে মাঝেই পার্টি দিয়ে অত্যন্ত প্রিয় হয়ে উঠেছে সে সবার কাছে। বছর কয়েকের নিয়মিত যাতায়াতে সবার সঙ্গেই খাতির জমিয়ে নিয়েছে এই সদালাপী সুদর্শন ধনী যুবক। লারসেন সাহেবও একে খুব স্নেহের চোখে দেখেন।
‘ওই দেখো। ওখানে বুদ্বুদ কীসের বলতে পারো?
টর্চের আলোয় পানির উপর অনেকগুলো বুদ্বুদ দেখল ইসলাম। বলল, ‘আশ্চর্য! এ তো অ্যাকুয়ালাঙ-এর ভুড়ভুড়ি। ওখানে কাউকে নামিয়েছ নাকি নীচে?
না। ওই টিলার কাছ থেকে কেউ পানির নীচ দিয়ে এসেছে বাঁধের গায়ে। লোকটা কী করছে জানা দরকার।’
‘কাল গিয়েছিলাম কক্সবাজারের সী-তে ফিয়াসের জন্যে রেয়ার কিছু শঙ্খ। তুলতে। গাড়ির পেছনে অ্যাকুয়ালাঙটা বোধহয় রয়ে গেছে। নেমে দেখব নাকি?’
দাঁড়াও, আবদুলকে স্টোরে পাঠিয়েছি-ও আসুক, দুজন একসঙ্গে নেমো। পানির নীচে একাধিক লোক থাকতে পারে, অস্ত্রশস্ত্র ও থাকতে পারে।’
হেসে উড়িয়ে দিল কথাটা ইসলাম। তারপর গাড়ির পিছন থেকে কম্প্রেসড এয়ারের সিলিণ্ডার ফিট করা কিম্ভুতকিমাকার ডুবুরি পোশাক বের করে পরে নিল। আধ মিনিটের মধ্যে। কাটাতারের বেড়া টেনে ধরলেন মি. লারসেন, বাঁধের গায়ে সাজিয়ে রাখা বড় বড় কালো পাথরগুলোর উপর সতর্ক পা ফেলে তরতর করে। নেমে গেল ইসলাম পানিতে।
কিছুদূর নেমেই ভাইজারের কাঁচের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার দেখতে পেল, প্রায় সত্তর-আশি ফুট নীচে একটা তীব্র আণ্ডারওয়াটার টর্চ জ্বেলে কী যেন করছে। আনলাকি থারটিন। আনলাকিই বটে! হাসল ইসলাম।
পনেরো ফুট কাছে যেতেও যখন লোকটা টের পেল না তখন পকেট থেকে সরু একটা টর্চ বের করল ইসলাম। ওর ভয় কেবল লোকটার পাশে মাটিতে রাখা। হার্পন বন্দুকটাকে।
আর তিন হাত এগোতেই হঠাৎ তেরো নম্বর কাজ বন্ধ করল, তারপর চট করে ঘুরে ইসলামের দিকে টর্চের আলো ফেলেই একটানে হার্টুনটা তুলে নিল হাতে। টর্চের তীব্র আলো পড়ায় মস্তবড় একটা কাতলা মাছ সড়াৎ করে সরে গেল। সামনে দিয়ে।
সঙ্গে সঙ্গেই হাতের পেন্সিল-টর্চ জ্বেলে সিগনাল দিল ইসলাম। হার্পনের ট্রিগার থেকে আঙুলটা সরে গেল তেরো নম্বরের। প্রত্যুত্তরে সে-ও সিগনাল দিয়ে হার্টুনের সেফটিক্যাচটা আবার তুলে দিল উপরে। তারপর সেটা নামিয়ে রেখে। একটু বিশ্রাম নেয়ার জন্যে বসে পড়ল মাটিতে। এতক্ষণ একটানা পরিশ্রমে রাবারের ভিতরে দর দর করে ঘাম ঝরছে ওর দেহ থেকে। ভাবল, বোধহয় তার। কাজ তদারক করবার জন্যে এল কেউ। কিন্তু কেন জানি বুকের ভিতরটা একবার কেপে উঠল ওর।
বরফে গর্ত করবার একটা ফিন-বোর দিয়ে বাঁধের গায়ে গর্ত খুঁড়ছে তেরো নম্বর। ফিনল্যাণ্ডে এই যন্ত্রের ব্যবহার খুব বেশি। হাতে তুলে নিয়ে দেখল ইসলাম প্রায় সাড়ে তিন ফুট লম্বা আর পানির নীচে সের দুয়েক ওজনের এই যন্ত্র অনায়াসে বারো ইঞ্চি ব্যাসের গর্ত তৈরি করতে পারে মাটিতে। মিনিয়াপোলিসের রাপালা কোম্পানির তৈরি এই ফিনবোর। ইচ্ছে করলে অনেক লম্বা করা যায় একে রড জুড়ে জুড়ে।
বন্দুকটা হাতে তুলে নিল ইসলাম। দেখল ফ্রান্সের নাম করা চ্যাম্পিয়ান
হার্পুন গান ওটা। সমুদ্রে হাঙ্গর, ব্যারাকুড়া, এমনকী বিশাল সব তিমি পর্যন্ত মারতে এ জিনিস অদ্বিতীয়।
. আবার কাজ করবার ইঙ্গিত করতেই আনলাকি থারটিন যন্ত্রটা নিয়ে ঝুঁকে পড়ল গর্তের উপর। আর ওর অজান্তে ইসলামের ডান হাতে ধরা সিরিঞ্জের সূচটা ঢুকে গেল রাবারের পোশাক ভেদ করে ওর পিঠে, হার্টের কাছটায়। সঙ্গে সঙ্গে ঢলে পড়ে গেল লোকটা, ঠিক যেন ঘুমিয়ে পড়ল এক মুহূর্তে।
এবার গর্তের মধ্যে সম্পূর্ণ ঢুকিয়ে দিল ইসলাম যন্ত্র ও তার সঙ্গের রডগুলো। তারপর মুখটা মাটি দিয়ে চেপে বন্ধ করে দিল।
উজ্জ্বল আলোটা ঘুরিরে ফিরিয়ে অনেক মাছ দেখতে পেল সে। যেন একটা মস্তবড় অ্যাকুয়েরিয়ামের মধ্যে চলে এসেছে ওছোট ছোট মাছ নির্ভয়ে ওর পাশ দিয়ে খেলে বেড়াচ্ছে। বড় বড় গলদা চিংড়ির উপর আলো পড়তেই আট হাত-পা কুকড়ে কয়েক পা পিছিয়ে যাচ্ছে, ওগুলো লেজের উপর ভর করে-টুকটুকে লাল চোখ বের করে অবাক হয়ে দেখছে ওকে। অসংখ্য কাঁকড়া গর্ত থেকে অর্ধেকটা শরীর বের করে ওর গতিবিধি লক্ষ করছে-এগোলেই সুড়ৎ করে ঢুকে পড়বে গর্তে। টর্চের আলো দেখে কৌতূহলী বড় বড় রুই কাতলা ঊদ্র দূরত্ব বজায় রেখে আশপাশে ঘুরঘুর করছে।