হামি মনে কোরলাম কে, ‘হামি জানে না,’ দুসরা কোঈ গাড়ি হোগা। বার বার বলি, ‘না, না, ডাবল-ডেক ট্রাম, ডাবল-ডেক ট্রাম।’ হা হা করে হাসল কিছুক্ষণ আবদুল।
‘ওয়্যাস্ট পাকিস্তানে দুই পোয়সাকে ‘টাকা’ বোলে। পারথোম যেখোন হোটেলে খেলাম, বিল হোল এক টাকা। হামি ভি খোদার কাছে হাজার শোকর গোজার কোরে দুই পোয়সা বের কোরে দিলাম। দেখি, হোটেলওয়ালা মারতে চায় দিললাগী দেখে। আবার এক পেট হেসে নিল সে। আরেকটা সিগারেট ধরাল রানা।
‘কিন্তু এই পাহাড়ী লোগ বোড়ো ভাল, হুজুর। দাস রাকোম ট্রাইব আছে: মগ, চাকমা, পাঙকো, তিপরা, খেয়াঙ, কুকী, মোরাঙ, তুঙতু-নিয়া, লুসাই… লুসাই হোলো সব কিশ্চান, বোড়ো মেহমান নেওয়াজী। বহোত কামলা পাওয়া যায়। সিখানে। ‘গুড বাই’-কে বোলে ‘দাম তা কিঙ-তু,’ ‘তুমহারা ক্যয়া নাম’-কে বোলে ‘নামিঙ তু’…’
হঠাৎ রানার বিস্ফারিত চোখের দিকে চেয়ে থেমে গেল আবদুল। বিদ্যুৎ। শিহরন যেন বয়ে গেছে রানার শরীরে। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইল ও ড্যামের দিকে। ব্ল্যাকবোর্ডে সুলতার আঁকা নক্সটা পরিষ্কার ফুটে উঠল ওর চোখের সামনে। এই ছবি! এই ছবিই আঁকছিল সুলতা কবীর চৌধুরীর বাড়িতে ব্ল্যাকবোর্ডের উপর। মনে মনে তিনটে লাল চিহ্ন আঁকল রানা বাঁধের গায়ে। নিঃসন্দেহ হলো সে, যখন ঠিক বাম দিকের চিহ্নটার উপর এসে লারসেন সাহেব বললেন, এই সেই স্পট।
৭
ফিরতি পথে রানার মাথার মধ্যে এত দ্রুত চিন্তা চলল যে গাড়ির মৃদু গুঞ্জন ধ্বনিটা না থাকলে মি. লারসেন আর আবদুল বোধহয় স্পষ্ট শুনতে পেত সে-চিন্তা। বিগত দুই দিনের ঘটনাগুলো এক সূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে, এখন ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার প্ল্যান চলছে রানার উর্বর মস্তিষ্কে। তা হলে দাঁড়াল এই, ভারতীয় ডিনামাইট এই বাঁধের তলায় বসানো হয়ে গেছে। এখন কেবল বোতাম টেপার অপেক্ষা। ওগুলো খুঁজে বের করে ওঠাতে পারলে অকেজো করে দেয়া যেত। ওর প্রথম কাজ, ওগুলো উদ্ধার করা। তারপর চৌধুরীর আস্তানা বের করে ধরতে হবে তাকে। সহজে হাল। ছাড়বার পাত্র কবীর চৌধুরী নয়। চারদিকে ছায়ার মত কাজ করছে তার। লোকজন। মস্ত বড় জাল বিস্তার করেছে সে কাপ্তাইয়ে অনেক ভাবনা চিন্তা করে। …কিন্তু কবীর চৌধুরী বাধ ভাঙতে চাইছে কেন? মতলবটা কী ওর?
ছোট্ট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন শহর এই কাপ্তাই। শান্ত সৌম্য একটা ভাব বিরাজ করছে এর অন্তরের গভীরে। রিজারভয়ের থেকে বাশের চালান মাথার উপর দিয়ে। রাস্তা পার করে মরা নদীতে নামিয়ে দেবার জন্যে ওভারহেড ক্রেন রয়েছে একটা। এ বাঁশ আসে উত্তর থেকে কর্ণফুলী পেপার মিলসের জন্য। হাতের ডানদিকে ফিশারীর অফিস। সেই পথে গিয়ে আবার ডান দিকে মোড় ঘুরলেই পাওয়ার। হাউস। এক লক্ষ বিশ হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে এখনকার এই নীরব পাওয়ার হাউস।
বাঁধ শুরু হবার আগেই সারি সারি অফিসারস কোয়ার্টার। বাঁধ পার হয়ে। ডানদিকে রাস্তাটা মোড় ঘুরেছে। নীচে নেমে গেলে বাঁয়ে ডাকবাংলো, ডানে পুলিশের ফাড়ি, তারপর আবার বাঁয়ে বাজার। আর বাধ থেকে মোড়টা না ঘুরে সোজা চলে গেলে স্পিলওয়ে-উদ্বৃত্ত পানি বের করে দেয়া হয় এখান দিয়ে।
মি. লারসেনের অফিসের সামনে অনেক লোকের ভিড় দেখা গেল দূর থেকে। ব্যাপার কী? দ্রুত চালিয়ে এনে কাছেই পার্ক করলেন মি. লারসেন-তিনজনই লাফিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে।
তখনও আগুন সম্পূর্ণ নিভে যায়নি। ছিন্ন-ভিন্ন গদিগুলো পুড়ছে। অফিসের সামনে দাঁড়ানো রানার ফোক্সভাগেনের ধ্বংসাবশেষ এখন এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ে আছে।
জিজ্ঞেস করে জানা গেল মিনিট দশেক আগে প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণের শব্দ শুনে অফিস থেকে সবাই হুড়মুড় করে বেরিয়ে দেখে গাড়িটার এই অবস্থা। পেট্রল ট্যাঙ্কে আগুন লেগে দাউ দাউ করে জ্বলছে। আশপাশে কেউ ছিল না তখন।–গাড়ির ভিতরেই বোধহয় আগে থেকেই ছিল বোমাটা।
কেউ টাইম-বম্ব দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে রানার গাড়ি।
অফিস কামরায় ফিরে এসে মি. লারসেন রানার দিকে চেয়ে একটু কাষ্ঠ হাসি হাসলেন। লাল মুখ তার ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। প্রাণহীন হাসিটা মুখ-বিকৃতির মত। দেখাল।
‘আপনাকে খুন করতে চেয়েছিল ওরা।’
তা চেয়েছিল। বিচলিত ভাবটা ঢাকার জন্য সিগারেট ধরাল রানা।
‘আমার গাড়িতে না গিয়ে যদি ওই গাড়িটায় উঠতেন তা হলে?’ আতঙ্ক কাটছে না বিহ্বল লারসেনের। উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন তিনি রানার জন্যে।
যা হবার তাই হতো। এই নিয়েই তো আমাদের কারবার, মি. লারসেন। যদি আপনার মত করে ভাবতে যেতাম, তা হলে আজই চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে হতো। একদিন হঠাৎ এভাবেই হয়তো মৃত্যু ঘটবে আমার… কিন্তু এসব কথা যতটা মন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারি ততই আমাদের পক্ষে মঙ্গল। এখন কাজের কথায় আসা যাক। আমি এই ড্যামের একটা ছবি আঁকব এবং তার গায়ে তিনটে চিহ্ন দেব। তার আগে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলছি।’ একটু থেমে মনে মনে গুছিয়ে নিল রানা কথাগুলো।
‘একজন লোক খুব শক্তিশালী এক্সপ্লোসিভ দিয়ে ড্যামটা উড়িয়ে দিতে চায়।’
‘কেন??? লারসেন সাহেব হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলেন চোখ দুটো কপালে তুলে। অসাবধানে ধরা মোটা চুরুটটা পড়ে গেল হাত থেকে।
তা আমি জানি না। টিএনটি এসেছে তার কাছে আমাদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন। কোনও দেশ থেকে। আর আপনাদের কথা শুনে যতদূর বুঝলাম সেগুলো সে ইতিমধ্যেই জায়গা মত বসিয়েও দিয়েছে।’