সংক্ষেপে সেদিন সন্ধ্যার ঘটনাগুলো বললেন মি, লারসেন। তারপর বললেন, ‘সেদিন আমি রাফিকুল ইসলামের মাছের গল্পে ভুললেও আবদুলের তীক্ষ্ণ চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি লোকটা। বাংলোয় ফেরার পথে ও আমাকে চার্জ করল ইসলামকে পানিতে নামতে দেয়ায়, বলল লোকটাকে জ্যান্ত ধরে আনা যেত, ইসলাম যদি ওকে পানির তলায় খুন না করত। সব ব্যাপার চাপা দেয়ার জন্যে লোকটার মুখ চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছে সে। ভিতরে আরও কিছু ব্যাপার আছে-অ্যাণ্ড হি ওয়াজ রাইট! সেদিন রাতেই তারা দুই-দুইবার অ্যাটেমপ্ট নিয়েছে। আবদুলের ওপর। খুব হুঁশিয়ার না থাকলে সে রাতেই শেষ হয়ে যেত আবদুল। যাক, সে কথায় পরে আসা যাবে। আবদুলের অবিশ্বাস্য মন্তব্য মাথার মধ্যে এমন ঘুরপাক খাচ্ছিল যে সে রাতে ভাল করে ঘুমোতে পারিনি। সকালে উঠেই হাসপাতালে গিয়ে হাজির হলাম। লোকটা কীভাবে মারা গেছে জানেন? পটাশিয়াম সায়ানাইড। কেউ ইনজেক্ট করেছে ওর পিঠে। ইসলাম গায়েব-ওকে পাওয়া যাচ্ছে না। হাসপাতালে যাচ্ছি বলে সোজা চিটাগাং চলে গেছে।
ইসলামকে তুমি কেন সন্দেহ করলে, আবদুল?’ আবদুলের দিকে চেয়ে প্রশ্ন। করল রানা। পানির নীচে মাঝপথে দেহটা আবদুলের হাতে ছিল, তাকেও তো খুনী হিসেবে সন্দেহ করা যেতে পারে।
‘সেটা সাহেবকে বলেছি আমি, উনিই বলুন।’ কথাটা বলতে বলতে একটা স্লিপ প্যাড থেকে ঘ্যাঁচ করে টান দিয়ে একটা পৃষ্ঠা ছিঁড়ে নিয়ে কিছু লিখল আবদুল, তারপর লারসেন সাহেবের চোখের সামনে ধরল লেখাটা।
লারসেন সাহেব ওটার উপর একবার চোখ বুলিয়ে বললেন, ‘১৯৬০ সালে যখন চ্যানেল ক্লোজ করা হলো তখন একটা ষড়যন্ত্রের কথা প্রকাশ পেয়ে যায় UTAH এবং IECO আগে থেকে টের পেয়ে সাবধান না হলে (রানার চোখের সামনে কাগজটা ধরল এবার আবদুল। তাতে আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা, ‘সামবডি লিসনিং!’) আজ আর ড্যাম কমপ্লিট করতে হত না। অন্ততঃপক্ষে আরও পাঁচ বছরের জন্যে পিছিয়ে যেত কাজ। সেই ঘটনার পর আবদুল আমার সঙ্গে হাতি শিকারে গিয়ে এই ইসলামের ব্যাপারে সাবধান…’
বিড়ালের মত নিঃশব্দে ডানধারের একটা দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। আবদুল। এক ঝটকায় দরজাটা খুলেই কলার ধরে ভিতরে টেনে আনল একটা। লোককে। এত আচমকা ঘটল ব্যাপারটা যে প্রথমে একেবারে হকচকিয়ে গিয়েছিল। লোকটা। কান পেতে ঘরের কথাবার্তা শুনছিল সে নিবিষ্ট চিত্তে, হঠাৎ এমন বাঘের থাবা এসে পড়বে কে ভাবতে পেরেছিল! কিন্তু চট করে সামলে নিয়ে এক ঝটকায়। আবদুলের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড় দিল দরজার দিকে। কিন্তু ততক্ষণে রানা, লারসেন দুজনেই এগিয়ে এসেছে। লোকটাকে ধরে পিছমোড়া করে হাত দুটো বেধে ফেলা হলো। অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গেল না কিছুই।
লারসেন সাহেব থানায় ফোন করে রানার দিকে ফিরে বললেন, ‘এ হচ্ছে আমাদের ডিসপ্যাঁচ ক্লার্ক মতিন। এর সম্বন্ধেও আবদুল আমাকে সাবধান করেছিল, আমি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম ওর কথা।
কয়েকটা প্রশ্ন করেই বোঝা গেল কোনও কথাই বেরোবে না মতিনের পেট থেকে। পরিষ্কার বলে দিল মতিন, ‘নির্ঘাত মৃত্যুর চাইতে জেলের ভাত খেয়ে বেঁচে থাকা অনেক ভাল। একটা কথাও বের করতে পারবেন না আমার কাছ থেকে, যত নির্যাতনই করেন না কেন।
রানা মনে মনে বলল-কথা তোমাকে বলতেই হবে বাছাধন। স্কোপালামিন। টুথ সেরামের একটা ইনজেকশন পড়লেই মুখে খৈ ফুটবে। কিন্তু কিছুই বলল না সে। মৃদু হেসে মি. লারসেনকে বলল, ‘চিটাগাং এসেছিলাম অন্য কাজে, এখন দেখছি এক মহা ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। যাক, আমি সেদিন সন্ধ্যার সেই জায়গাটা দেখতে চাই। একটা সিনিয়র সার্ভিস ধরাল ও।
চলুন, আপনাকে বোটে করে নিয়ে গিয়ে দেখাব।’
ওসি-কে আড়ালে ডেকে কিছু বলল রানা, নিজের আইডেন্টিটি কার্ডও। দেখাল, তারপর ফোক্সভাগেনের দরজাটা খুলল, ভুরুজোড়া একটু কোঁচকাল, তারপর আবার কী মনে করে দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করে লারসেন সাহেবকে বলল, চলুন, আপনার গাড়িতেই যাই, কথা বলতে বলতে যাওয়া যাবে।’
‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। আসুন। ভিতর থেকে পাশের দরজাটা খুলে দিলেন। লারসেন।
‘আচ্ছা, কালই তো প্রেসিডেন্ট আসছেন, তাই না? রানা মুখে বলল এই কথা, কিন্তু মনে মনে ভ্রুকুটি করে চিন্তা করল, ফোক্সভাগেনের দরজটার আলগা থাকবার তো কথা নয়! তারপর ভুলে গেল সে কথা।
‘হ্যাঁ, লঞ্চঘাটে যাবার সময়ই দেখবেন মাঠের মধ্যে কী সুন্দর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। নানান রঙের বালব দিয়ে সাজানো হয়েছে স্টেজ। পাকিস্তান আর ইউএসএ-র পতাকা আঁকা হয়েছে পেছনে; বন্ধুত্বের এম্বলেম দুই হাত আঁকা হয়েছে তার নীচে। সামনে অসংখ্য লোকের বসবার ব্যবস্থা। প্রেসিডেন্টের সামনে। টেবিলের ওপর একটা সুইচ থাকবে পাওয়ার হাউস থেকে কানেক্ট করা। বক্তৃতার পর সেই সুইচ টিপবেন প্রেসিডেন্ট-আর ঝলমল করে জ্বলে উঠবে সমস্ত বাতি। ওপেন হয়ে যাবে প্রজেক্ট। কী চমৎকার নাটকীয় হবে, তাই না?
স্পীডবোটে উঠে আবদুল একমনে বকে যাচ্ছিল, ‘আট বোচ্ছোর ধরে কাজ করছি আমি কাপ্তাইয়ে, হাজুর। আমি যেখোন কারাচি-হায়দ্রাবাদ টানাসপোট সার্ভিসে কাম করি, তোখোন হামার এক দোস্ত ছিল বঙ্গালি-বাড়ি চিটাগাঁও। তার কাছে বহোত গপ সুনছিঃ ষাট-সত্তর মঞ্জিল দালান আছে চিটাগাঁওয়ে হাজার হাজার। ডাবল-ডেক ট্রাম চোলে বহোত চওড়া রাস্তায়। ভাবলাম এ শাহার তো দেখতে হোবে। যোখোন পারথোম আয়লাম, আদমীকে জিগাই, ‘ভাইয়া, ডাবল ডেক ট্রাম চালতা কৌন রাস্তে মে?’ কেউ কোথা বুঝে না, ট্রামই দেখে নাই কাভি, বোলে, ‘হামি জানে না।’