যাহ, সই না আরও কিছু! ভয়ে এমন কাঁপছিল হাতটা-গুলি করলাম হার্ট লক্ষ্য করে, ছুটে লাগল গিয়ে কপালে।’
হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল আবদুল হাই। রানাও যোগ দিল হাসিতে। বলল, ‘ভালই সই বলতে হবে। যাক, এখন কলিং বেলটা টিপে দাও তো, কিছু খেয়ে নিয়ে আধ ঘণ্টার মধ্যে বেরিয়ে পড়ব।’
‘কোথায় যাচ্ছ?’ বেলটা টিপে দিয়ে জিজ্ঞেস করল সুলতা।
কাপ্তাই।’
কাপ্তাই কেন?’
কাজ আছে।’
‘অসুস্থ শরীর নিয়ে আজ না গেলেই কী নয়?’
আবদুল হাই মুখ টিপে হাসল। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে রানা বলল, ‘না, যেতেই হবে।
আর আমি?
তুমি ইচ্ছে করলে যেতে পারো আমার সঙ্গে। ইচ্ছে করলে পুলক বার সঙ্গে ঘুরে ফিরে দেখতে পারো চিটাগাং শহর।
‘আমি তোমার সঙ্গেই যাব।’
‘গেলে জলদি কাপড় পরে তৈরি হয়ে নাও।’
সুলতা যেই কাপড় ছাড়তে বাথরুমে ঢুকল, অমনি ইশারায় হাইকে কাছে ডাকল রানা। বিছানার পাশে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল হাই।
‘কবীর চৌধুরীকে চেনেন? ২৫৭ নম্বর বায়েজিদ বোস্তামী রোডে ওর বাসা।
‘চিনি মানে? খুব ভাল করে চিনি।
‘ওর সম্বন্ধে যা জানেন সংক্ষেপে বলুন।
‘তিনিই তো চৌধুরী জুয়েলার্সের মালিক। অজস্র টাকা। খুবই বিনয়ী ভদ্রলোক। তেমনি আবার দান খয়রাতে দরাজ হাত। এমন লোক হয় না। বহু দাঁতব্য চিকিৎসালয়, স্কুল আর কলেজ ওঁরই টাকায় চলে। জনসাধারণের মধ্যে যেমন সুনাম আছে ওর, তেমনি আছে সরকারী অফিসের উঁচু সার্কেলে দহরম মহরম। প্রথম দিকে প্রায়ই ঢাকা-করাচি–লাহোর এমনকী নিউ ইয়র্ক-লণ্ডন-মস্কো পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি করেছেন, এখন চিটাগাং-এর বাইরে বড় বেশি যান না। কী ব্যাপার! হঠাৎ তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছেন যে?
‘এই কবীর চৌধুরীই আমাদের টার্গেট। একটু আগে যে সব লোককে পাচার
করলেন থলেয় ভরে তারা তারই অনুচর।
হাঁ হয়ে গেল আবদুল হাইয়ের মুখটা।
বলেন কী, মশাই?’
‘মশাই নয়, সাহেব; কিন্তু যা বলছি ঠিকই বলছি। ভারতীয় ডিনামাইটগুলো তারই কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে কাল রাতে। আমার উপর আক্রমণের বহর দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আমাকে সে চিনে ফেলেছে। ও-ই যে আসল লোক, এতক্ষণ সেটা জানতাম একা আমি, এখন আপনিও জানলেন। কাজেই আমারই মত আপনার মাথার ওপরেও এই মুহূর্ত থেকে ঝুলল ওর মৃত্যু পরোয়ানা।
‘আশ্চর্য কথা শোনালেন আপনি!
‘বিস্মিত হবেন না, মি. হাই। দেয়ার আর মোর থিংস ইন হেভেন অ্যাণ্ড আর্থ… ইত্যাদি, ইত্যাদি। এখন কাজের কথায় আসা যাক। খুব সাবধানে নিজের গা বাঁচিয়ে ওর সম্পর্কে যতখানি সম্ভব তথ্য উদ্ধার করুন, আজই। আমার যতদূর বিশ্বাস, চিটাগাং-এর কাছাকাছি ওর আরেকটা আস্তানা আছে–সেখানে সে ল্যাবরেটরি করেছে একটা। সে ব্যাপারেও একটু সন্ধান নেবেন। কিন্তু সাবধান, চৌধুরীর বাড়ির ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করবেন না, ওটা একটা দুর্গম দুর্গ। আর একটা কাজ আছে। আপনি পাহাড়তলী স্টেশনে গিয়ে সুলতার নামে একটা টেলিগ্রাম করবেন। টেলিগ্রামের নীচে প্রেরকের নাম থাকবে জেটিটি-লিখবেন, কবীর চৌধুরী শত্রু, যেন সে সুবীরের কথা মত চলে।
‘আপনি কাপ্তাই থেকে ফিরছেন কখন?’
‘ঠিক জানি না। তবে মনে হয় বেলা চারটের মধ্যেই ফিরতে পারব।’
‘বেশ, আমি চললাম। এর মধ্যেই সব খবর বের করে ফেলার চেষ্টা করব। ওহহো, ভুলেই গিয়েছিলাম; কাপ্তাই থেকে ফিরে সোজা আমার বাংলোতে চলে যাবেন। আপনাদের মালপত্র আমার ওখানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি আমি। একটা চমৎকার ঘর আপনাদের দুজনের জন্যে রেডি রাখা হবে।’
রানা কিছু বলতে যাচ্ছিল, বাধা দিয়ে আবদুল হাই বলল, এটা আমার অনুরোধ নয়, স্যর… হেড় আপিসের হুকুম। আমি চললাম। গুড বাই!’
ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল আবদুল হাই।
চিটাগাং থেকে কাপ্তাই পঁয়ত্রিশ মাইল। অতি চমৎকার রাস্তা। মোড় ঘুরবার সময় রাস্তার সুপার এলিভেশন এত সুন্দর যে যেখানে স্পীড লিমিট টেন মাইলস লেখা, সেখানেও পঞ্চাশ-ষাট মাইল বেগে অনায়াসে ইউ টার্ন নেয়া যায়। পথে পাঁচটা চেক-পোস্ট।
এক লক্ষ বত্রিশ হাজার ভোল্টের গ্রিড সাব-স্টেশন দেখা গেল রেলগেট পার হয়ে কিছুদূর যেতেই হাতের বাঁয়ে। বিটকেল সব যন্ত্রপাতি, কাঁটাতার দিয়ে এলাকাটা ঘেরা।
দু’পাশে উঁচু টিলা-মাঝে মাঝে পাহাড়ের উপর দিয়ে গেছে আঁকাবাঁকা মসৃণ পথ। চন্দ্রঘোনা পার হয়ে কর্ণফুলীর পাশ দিয়ে যাবার সময় চোখে পড়ে অপূর্ব সুন্দর সব দৃশ্য! নদীর অপর পাড়েই উঁচু পাহাড়। লম্বা লম্বা গাছ আর ছোট আগাছায় ভর্তি সেগুলো, শহুরে মনকে টানে অন্য এক অচঞ্চল সাদামাটা জীবনের প্রতি, নীরব ইঙ্গিতে। চারদিকে কেবল পাহাড় আর পাহাড়।
হঠাৎ একটা সামান্য ব্যাপার চোখে পড়ল রানার। রাস্তার পাশে টেলিফোনের তার এতক্ষণ ছিল চারটে, নতুন চকচকে একটা তার রোদে ঝিলমিল করছে বলে রানা লক্ষ করল তার এখন দেখা যাচ্ছে পাঁচটা। রানা মোটেই আশ্চর্য হয়নি প্রথমে, কিন্তু অবাক হলো কাপ্তাইয়ের শেষ চেক-পপাস্টটা পার হবার পর যখন দেখল তার আবার চারটেই দেখা যাচ্ছে-পঞ্চমটা নেই।
ভিআইপি রেস্ট হাউসে একটা কামরা বুক করে সুলতাকে সেখানে রেখে সোজা মি. লারসেনের অফিসে গিয়ে উঠল রানা। পরিচয় পেয়ে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন তিনি। তিনিই পিসিআই-এর সাহায্য চেয়ে টেলিগ্রাম করেছিলেন ডিফেন্স সেক্রেটারির কাছে। আবদুলকে ডাকিয়ে এনে বাইরে দাঁড়ানো দারোয়ানকে বিশেষ নির্দেশ দিয়ে ঘরের সব দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিলেন তিনি।