দৌড়ে এসে বাথরুমের সামনে দাঁড়াল সুলতা। কয়েকবার ডাকল, ‘শুনছ, এই, শুনছ?’ ভিতর থেকে কোনও জবাব এল না। আবার ডাকল। কোনও জবাব নেই। কী মনে করে চাবির গর্তে চোখ রাখল সে। ফুটো দিয়ে দেখল, অপরিচিত এক লোক উবু হয়ে বসে আছে বাথটাবের মাথার কাছে। এক হাতে মস্ত এক ছুরি, আর অপর হাতে পানির মধ্যে কী যেন ঠেসে ধরে আছে।
মুহূর্তে পরিষ্কার হয়ে গেল সুলতার কাছে গোটা ব্যাপারটা। হত্যা করা হচ্ছে সুবীরকে। ছুটে গিয়ে পিস্তলটা নিয়ে এল সে বালিশের তলা থেকে। বাথরুমের দরজার হাতলটা ঘোরাতেই খুলে গেল দরজা। ধাক্কা দিয়ে হাঁ করে দিল কপাট, তারপর লোকটার বুক লক্ষ্য করে টিপে দিল ট্রিগার।
সোজা গিয়ে গুলি লাগল লোকটার কপালে-দুই চোখের ঠিক মাঝখানটায়। দ্বিতীয় গুলির আর প্রয়োজন হলো না। গভীর ক্ষতস্থলটা দেখতে হলো ঠিক শিবের তৃতীয় নেত্রের মত। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এল রক্ত পড়ে গেল লোকটা মেঝের উপর। কলবল করে লাল রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে ড্রেনের দিকে।
বহুকষ্টে রানাকে টেনে বের করল সুলতা বাথটাব থেকে। পরিশ্রম আর উত্তেজনায় নিজেই হাঁফাচ্ছে সে, তাই ঠিক বুঝতে পারল না নাড়ী চলছে কি না। ফার্স্ট এইড কোর্স কমপ্লিট করাই ছিল-আর্টিফিশিয়াল রেসপিরেশন দিতে আরম্ভ করল সে রানার মুখে মুখ লাগিয়ে, আর বুকের পাঁজরে দু’হাতে চাপ দিয়ে।
ঠিক এমনি সময় দমাদম ধাক্কা আরম্ভ হলো দরজায়। ভয়ে পাংশু হয়ে গেল সুলতার মুখ। হাত-পা ঠক ঠক করে কাঁপতে শুরু করল তার। নিশ্চয়ই পুলিশ এসেছে। বাথরুমে রক্তারক্তি কাণ্ড-নীচে মৃতদেহ-এদিকে সুবীর বেঁচে আছে না শেষ ঈশ্বরই জানেন! পাকিস্তানে এসে এবার হাতকড়া পড়ল ওর হাতে। জল বেরিয়ে এল চোখ দিয়ে। চোখ মুছে নিয়ে মন শক্ত করবার চেষ্টা করল ও। ভাবল, যে ক’জনকে পারি গুলি করে মেরে তারপর ধরা দেব। পিস্তলটা হাতে তুলে নিল। সুলতা।
দরজায় করাঘাতের শব্দ বেড়েই চলল। সেই সঙ্গে শোনা গেল কয়েকজন লোকের হাঁক-ডাক। ঠিক সেই সময়ে একটু নড়ে উঠল রানার দেহ। আশার আলো দেখতে পেল সুলতা। সুবীরের জ্ঞান ফিরিয়ে আনতে পারলে নিশ্চয় এ বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যাবে। এই অল্প পরিচয়ের মধ্যেই বুঝতে পেরেছে। সুলতা, এই অদ্ভুত, বেপরোয়া লোকটার উপর নিশ্চিন্তে নির্ভর করা যায়।
বার কয়েক জোরে জোরে কঁকি দিতেই লাল দুটো চোখ মেলে চাইল রানা। কয়েক সেকেণ্ড ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকল সে, ঘাড়টা ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক চাইল কয়েকবার, তারপর মনে হলো ধীরে ধীরে যেন বুঝতে পারছে সবকিছু।
কিছুক্ষণ চুপচাপ ছিল দরজার ওপাশের লোকগুলো, হঠাৎ দরজার ছিটকিনি। খুলে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল ঘরের মধ্যে। নীচের সেই সাদা পোশাক পরা লোকটা সবার আগে। ঘরে ঢুকে প্রথমেই হাতের ডান ধারে পড়ল খোলা বাথরুম।
মরিয়া হয়ে পিস্তল তুলল সুলতা। গুলিটা বেরোবার ঠিক আগের মুহূর্তে লাফিয়ে উঠে এক ঠেলায় সুলতার হাতটা লক্ষ্যভ্রষ্ট করে দিল রানা। তারপর এক ঝটকায় কেড়ে নিল পিস্তলটা ওর হাত থেকে। ছুটে যাওয়া গুলিটা ছাতে লেগে। চ্যাপ্টা হয়ে টুপ করে পড়ল সুলতার কোলের উপর। হতভম্ব সুলতা হাঁ করে রানার মুখের দিকে দুই সেকেণ্ড চেয়ে থেকে ফিসফিস করে বলল, ‘পুলিশ!
কী ব্যাপার, সুবীর বাবু! একি দশা আপনার? খুন হয়ে পড়ে রয়েছে কে? প্রশ্ন করল পিসি আই-এর চিটাগাং এজেন্ট আবদুল হাই এক সেকেণ্ডে অপ্রতিভ। ভাবটা কাটিয়ে উঠে।
প্রথমে রানা চেয়ে দেখল ইয়াকুবের লম্বা দেহটা। কুঁকড়ে পড়ে আছে সে মাটিতে–এখনও রক্ত বেরোচ্ছে কপাল থেকে। তারপর নিজের নগ্ন দেহের দিকে নজর যেতেই সম্বিত ফিরে পেল সে। একটানে ব্র্যাকেট থেকে তোয়ালেটা নিয়ে শরীরের মাঝামাঝি জায়গায় জড়িয়ে নিল। তারপরই আবার মাথাটা ঘুরে উঠে চোখ আঁধার হয়ে এল। আমাকে ধরুন…’ বলেই পড়ে যাচ্ছিল ও মেঝের উপর, লাফ দিয়ে এগিয়ে এসে ধরে ফেলল ওকে আবদুল হাই।
একজন সেপাইয়ের সাহায্যে রানাকে ওর বিছানায় এনে শোয়ানো হলো। নীচের বার’ থেকে আউন্স দুয়েক ব্র্যাণ্ডি এনে খাওয়ানো হলো ওকে। সিপাইদের ঘরের বাইরে দাঁড়াতে বলে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আদ্যোপান্ত ঘটনা শুনে নিল। আবদুল হাই সুলতাকে প্রশ্ন করে করে। তারপর বাইরে দাঁড়ানো সাব ইন্সপেক্টারকে কিছু বলল নিচু গলায়। বিনা বাক্যব্যয়ে একটা মোটা ক্যানভাসের বড় থলের মধ্যে মৃতদেহটাকে ভরে নিয়ে বাথরুমের রক্ত ধুয়ে পরিষ্কার করে দিয়ে চলে গেল সেপাইরা, যেন কিছুই হয়নি এমনিভাবে।
রানাকে চোখ মেলতে দেখে ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে আবদুল হাই সুলতাকে বলল, আপনি কিছু ভাববেন না, সুলতা দেবী। আমার নাম পুলক ব্যানার্জী। খাকি ড্রেস পরা ওই পুলিশ আমাদেরই ক্লোক। সরিয়ে ফেললাম লাশটা কারও টের পাবার আগেই। কিন্তু আর একটু হলেই সেম-সাইড করে ফেলেছিলেন, সুলতা দেবী। আমার তো আত্মাটাই চমকে গিয়েছিল একেবারে!’
‘আমি কী করে বুঝব বলুন যে আপনি পাকিস্থানী পুলিশের লোক নন?’ একটু সলজ্জ হাসি হেসে বলল সুলতা।
তা অবশ্যি ঠিকই বলেছেন। আপনার অবস্থায় পড়লে আমিও বোধহয় তাই করতাম। যাক, ভাগ্যিস ঠিক সময় মত সুবীর বাবুর জ্ঞান ফিরে এসেছিল! যা সই আপনার হাতের; নির্ঘাত কপালে লাগত গুলিটা!’