বাথটাবের কলটা খুলে দিয়ে বেসিনের সামনে দাঁত মেজে নিল রানা। আরও এক-আধটা কাজ সেরে নিয়ে স্লীপিং গাউনটা খুলে দেয়ালের গায়ে ব্র্যাকেটে ঝুলিয়ে রাখল। বাথটাব প্রায় ভরে এসেছিল-দু’মিনিট অপেক্ষা করে কল বন্ধ করে দিল রানা। তারপর সম্পূর্ণ দিগম্বর অবস্থায় নেমে পড়ল টাবের ভিতর।
মস্ত বড় বাথটাবটা মসৃণ পিচ্ছিল সাদা পাথরের তৈরি-ইচ্ছে করলে তার মধ্যে বাচ্চাদের সাঁতার শেখানো যায়। অকারণ পুলকে রানার গায়ে কাঁটা দিল। ধীরে ধীরে গা-হাত-পা ঘষতে ঘষতে গতরাতের মধুর ঘটনাগুলো মনে মনে উল্টে পাল্টে উপভোগ করছে ও হাসি মুখে।
হঠাৎ পিছনের পর্দাটা কেঁপে উঠল। সামনের দেয়ালে একটা ছায়া পড়ল আবছা মত। চমকে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল রানা উদ্যত ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে আছে ইয়াকুব। দ্রুত উঠবার চেষ্টা করল ও বাথটাব থেকে–কিন্তু পিছলে গেল হাত। তা, ছাড়া দেরিও হয়ে গেছে। ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে বাথরুমের মধ্যে পর্দার আড়ালে অপেক্ষা করছিল ইয়াকুব, সুযোগ বুঝে এক ঝটকায় পর্দা সরিয়ে রানার মাথার কাছে এসে দাঁড়াল সে। তারপর এক হাতে রানার চুলের মুঠি চেপে ধরল, মাথাটা চলে গেল পানির তলায়।
চোখ বন্ধ করে রানা আশা করছিল এবার ছুরিটা আমূল ঢুকে যাবে ওর বুকের ভিতর। পানির নীচে টু শব্দ করতে পারবে না ও। লাল হয়ে যাবে বাথটাবের।
পানি, নিঃশব্দে কয়েক সেকেণ্ড ছটফট করে মৃত্যু হবে তার। ছুরিটা যখন বিধবে, খুব বেশি কি কষ্ট হবে?
তিন-চার সেকেণ্ড অপেক্ষা করবার পরও যখন তার বুকটা অক্ষত রইল তখন চোখ মেলে দেখল রানা যে ছুরিটা হাতে ধরাই আছে-সেটা ব্যবহারের কিছুমাত্র আগ্রহ নেই ইয়াকুবের। ঠিকই তো, যখন নিঃশব্দে নিঝঞ্ঝাটে কাজ সারতে পারছে, তখন ছুরি-ছোরার কী দরকার?
দুই হাতে প্রাণপণে চেষ্টা করল রানা চুলের মুঠি ছাড়াবার। আরও শক্ত করে এঁটে বসল হাতটা-একটু আলগা হলো না সে মুঠি। ছটফট করতে থাকল রানা। একটু দম নেবার জন্যে। মনে হলো বুকের ছাতিটা ফেটে যাবে এখুনি।
চেষ্টা করে দেখল, হাত দুটো পৌঁছুচ্ছে না উপরে, পিঠে ভর করে পা-দুটো উপর দিকে উঠিয়ে বাথটাবের কিনারায় বাধাবার চেষ্টা করল রানা। কিন্তু সেয়ানা। ইয়াকুব তখন চুল ধরে টেনে ওর পিঠটা আলগা করে দেয়-পিঠের নীচে শক্ত কিছু না থাকায় ঝপাৎ করে পা-দুটো পড়ে যায় আবার টাবের মধ্যে।
প্রায় এক মিনিট ধরে একের পর এক নানান কৌশলে চেষ্টা করল রানা, কিন্তু বিফল হলো প্রতিবারই। পিচ্ছিল বাথটাব থেকে কিছুতেই মুক্তি পেল না। ঝিমিয়ে এল ওর দেহটা ক্রমে।
হঠাৎ রানা বুঝতে পারল যে ও মারা যাচ্ছে। সম্পূর্ণ নিরুপায় ও এখন। এর হাত থেকে তার মুক্তি নেই-বৃথাই চেষ্টা করা। মাথার কাছের লোকটা আসলে ইয়াকুব নয়, স্বয়ং যমদূত আজরাইল। মনে পড়ল জ্যোতিষী বলেছিল, আটান্ন। বছর পর্যন্ত ওর আয়ু। এইবার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেল যে জ্যোতিষশাস্ত্র ভুল, কিন্তু এই সত্যটা প্রমাণ করবার উপায় নেই-ও তো মরেই যাচ্ছে। প্রমাণ করবে কে? হাসি পেল রানার।
চোখ খুলে দেখল পানির উপর জুলজুলে দুটো চোখ চেয়ে আছে ওর দিকে। ঝকঝক করছে সাদা দাঁতগুলো, ছোট ছোট ঢেউয়ে ইয়াকুবের মুখটা দুলছে। এলোমেলো ভাবে।
ছোট একটা সরু শিকলে পা ঠেকল রানার। বুঝল, বাথটাবের পানি বেরোবার রাস্তাটা যে রাবারের ঢাকনা দিয়ে ঢাকা আছে, এ শিকল তারই সঙ্গে লাগানো। আস্তে করে শিকলটা পা দিয়ে সরিয়ে দিলেই ঢাকনিটা খুলে পানি বেরিয়ে যাবে টাব থেকে। কিন্তু অবসন্ন হয়ে গেছে রানার শরীর। একবার চেষ্টাও করল ও শিকলটা সরাবার, কিন্তু পা নড়ল না একটুও। মস্তিষ্কের হুকুম স্নায়ুগুলো আর বয়ে নিয়ে যেতে পারছে না অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাছে। সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলছে। রানা।
শেষবারের মত রানা চাইল উপর দিকে। তেমনি জ্বলজ্বল করছে দুটো চোখ। হঠাৎ তিনটে চোখ দেখতে পেল রানা। দুটো চোখের ঠিক মাঝখানটায় যেন আরেকটা চোখ দেখা যাচ্ছে। চুলের মুঠি আলগা হয়ে গেল। ঘুমিয়ে পড়ল অসহায় রানা।
.
রানা বাথরুমে গিয়ে ঢুকতেই সুলতা এগিয়ে গেল রানার এলোমেলো বিছানাটার দিকে। বালিশটা সরাতেই সাইলেন্সর লাগানো পিস্তলটা দেখল সে। চাদর সাট করে পিস্তলটা যত্নের সঙ্গে আঁচল দিয়ে মুছে আবার বালিশের তলায় রেখে দিল। সে। সুবীরের জিনিস বলে পিস্তলটাকেও আদর করতে ইচ্ছে করছে ওর।
বেশ অনেকক্ষণ কেটে গেল। একটা সিনেমা পত্রিকা নিয়ে ছবিগুলোর উপর। আনমনে চোখ বুলিয়ে গেল সে। নীচের ক্যাপশনগুলো পর্যন্ত পড়ল না। কিছুতেই মন বসছে না কোনও কাজে। মেরিলিন মনরোর আত্মহত্যার তাজা খবর। বেরিয়েছে সদ্য, সেই সঙ্গে তার জীবনী। সেটাতে পর্যন্ত মন বসল না। হলো কী ওর? উল্টাতে উল্টাতে যখন শেষ হয়ে গেল সব কটা পাতা তখন ঝপাৎ করে টেবিলের উপর পত্রিকাটা চিত করে ফেলে উঠে দাঁড়াল ও। বেরোচ্ছে না কেন সুবীর এখনও?
জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াল সে। বাইরে বেশ রোদ উঠেছে। সারি সারি একতলা দোতলা, তিনতলা বাড়িগুলোর ছাতের উপর বিছিয়ে পড়েছে সে রোদ। দৈনন্দিন হট্টগোলে লিপ্ত হতে চলেছে কর্মব্যস্ত চট্টগ্রাম বন্দর। এই আবছা কোলাহল নিরালায় বসে কান পেতে শুনলে ভালই লাগে।
হঠাৎ নীচের দিকে চোখ পড়তেই দেখল সুলতা দুজন লোক পড়ে আছে গলির মধ্যে। বোধহয় মারা গেছে। পাশে জটলা করছে কয়েকজন। একজন তাদের মধ্যে সাদা পোশাক পরা, আর বাকি ক’জনের খাকি পোশাক-পুলিশ।