থমকে দাঁড়িয়েছিল রানা, কিন্তু পরমুহূর্তে বুঝল ওটা লাউড স্পীকারের ধোঁকাবাজি। এক সেকেণ্ডে বাড়িটার নক্সা চিন্তা করে নিল ও। ডান দিকে যেতে হবে ওর এখন। ঘরের ডানধারে দেয়ালের গায়ে একটা পর্দা সরিয়ে দেখা গেল ওটা বাথরুম। আরেকটা দরজা দিয়ে পাশের ঘরে চলে এল রানা। যেন গোলক ধাঁধা। এর থেকে বেরোবার পথ কোনদিকে? আবার খুঁজতে খুঁজতে মস্ত আলমারির পিছনে একটা বোতাম পাওয়া গেল। সামনের দেয়ালটা ফাঁক হতেই অবাক হয়ে দেখল রানা ফাঁকা মাঠ দেখা যাচ্ছে সামনে। একটা সিঁড়ি দিয়ে কয়েক ধাপ নামলেই বাড়িটার পিছন দিকের প্রাঙ্গণ।
লাফিয়ে নেমে গেল রানা মাঠের মধ্যে। তারপর এক ছুটে চাকরদের ব্যারাকের বারান্দায় গিয়ে উঠল।
ঠিক সেই সময়ে রানার সমস্ত আশা ভরসা এক ফুয়ে নিভিয়ে দিয়ে দপ করে জ্বলে উঠল গোটা চারেক ফ্লাড লাইট। সারা মাঠ দিনের মত পরিষ্কার হয়ে গেল। দ্রুত তিনটে গুলি করে রানা তিনটে ফ্লাড-লাইট নিভিয়ে দিল, কিন্তু পঞ্চাশ গজ দূরে গুদাম ঘরের মাথায় যেটা জ্বলছে সেটাতে গুলি লাগল না।
এমন সময় ভয়ঙ্কর আওয়াজ তুলে কয়েকটা রাইফেল গর্জে উঠল এক সঙ্গে। রানার আশপাশে গুলিগুলো এসে বিধল, কোনওটা দরজায়, কোনওটা দেয়ালে। এক লাফে সরে গিয়ে দেয়ালের আড়াল থেকে দেখল রানা ছয়-সাতজন লোক রাইফেল নিয়ে এগোচ্ছে ওর দিকে। একজনের হাতে আবার একটা স্টার্লিং সাব মেশিনগান। এই প্রথম রানার আফসোস হলো এক্সট্রা ম্যাগজিন সঙ্গে না রাখার জন্য। পিস্তলে আর মাত্র তিনটে গুলি অবশিষ্ট আছে। এতগুলো লোককে ও ঠেকাবে কী করে? শিরশির করে মেরুদণ্ড বেয়ে একটা ভয়ের শিহরন উপরে উঠে এসে ওর মাথার পিছনে ঘাড়ের চুলগুলোকে খাড়া করে দিল।
কাছেই একটা লাউড স্পীকারে কে যেন বলল, ‘হাত তুলে দাঁড়াও, মাসুদ রানা, নইলে কুকুরের মত গুলি খেয়ে মরবে।’
এবার পাগলের মত ছুটল রানা গুদাম ঘরের দিকে। আরও এক ঝাঁক গুলি। বেরিয়ে গেল কানের পাশ দিয়ে। একটা পিচের ড্রামের আড়ালে বসে দুলে ওলি করল রানা। একজন রাইফেলধারী চিৎকার করে চিৎ হয়ে পড়ল। বাকি সবাই শুয়ে পড়ল মাটিতে। আবার দৌড়াল রানা। মাত্র একটা গুলি অবশিষ্ট আছে। চেম্বারে। শোল্ডার হোলস্টারের মধ্যে রেখে দিল রানা পিস্তলটা। তারপর এক লাফে মার্সিডিস লরির ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল।
লরিটায় স্টার্ট দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সামনের উইণ্ড-শীল্ডে কয়েকটা গুলি এসে বিধল। ভাঙা কাঁচের টুকরো ছিটকে এসে বিধল রানার চোখে-মুখে।
মাথা নিচু করে লোকগুলোর দিকে জোরে লরি চালিয়ে দিল রানা। গোলাগুলি বন্ধ করে যে যেদিকে পারল ছিটকে পড়ে জান বাঁচাল। এবার সোজা গেটের দিকে চলল লরি। আবার আরম্ভ হলো পিছন থেকে গুলিবর্ষণ। গেটের কাছাকাছি আসতেই পিছন দিকে একটা হ্যাণ্ড গ্রেনেড ফাটল বলে মনে হলো ওর। কিন্তু এখন আর ফিরে চাইবার অবসর নেই। সাত টনী মস্ত লরি হুড়মুড় করে গিয়ে পড়ল গেটের উপর। স্টিলের গেট দেয়াল থেকে খসে শুয়ে পড়ল মাটিতে। মৃদু হেসে বড় রাস্তায় চলে এল রানা লরি নিয়ে।
লরিটা সেখানেই রেখে রাস্তায় নেমে বাড়িটার দিকে চাইল একবার রানা। দোতলার বারান্দায় উজ্জ্বল আলোয় দেখা গেল কবীর চৌধুরীর প্রকাণ্ড দেহটা।
স্থির অচঞ্চল দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সে রানার দিকে।
হাত নেড়ে টাটা করল রানা।
৫
খুব দ্রুত হোটেলে ফিরবার প্রয়োজন অনুভব করল রানা। নির্জন রাস্তায় স্পীডমিটারের কাঁটা মাঝে মাঝে ‘৮০’ কে স্পর্শ করল। সেই সঙ্গে রানার অতি দ্রুত চিন্তা স্পর্শ করল কয়েকটা বাস্তব সত্যকে।
এত কাণ্ডের পরও কবীর চৌধুরী ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থাকল। তার বিরুদ্ধে একটা প্রমাণও সংগ্রহ করা যায়নি। পুলিশ ওর কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারবে না। ডিনামাইটগুলো নিয়ে কী করা হবে জানতে পারেনি রানা। যে তিমিরে সেই তিমিরেই আছে ওদের কার্যকলাপ, অথচ রানা নিজেকে দিনের আলোর মত পরিষ্কার করে দিয়ে এসেছে শত্রুপক্ষের কাছে। এখন যে কোনও দিক থেকে যে কোনও মুহূর্তে আক্রমণ চালাবে কবীর চৌধুরী। লক্ষ্যবস্তু তার জানাই আছে। মৃত্যু পরোয়ানা ঝুলছে এখন রানার মাথার উপর। ওকে শেষ করে দিতে পারলেই কবীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে সব তথ্য চাপা পড়ে যাবে। ওকে খুন করার চেষ্টায় কোনও রকম ত্রুটি রাখবে না এই অসামান্য প্রতিভাবান দুর্ধর্ষ বৈজ্ঞানিক।
এখন একমাত্র ভরসা সুলতা রায়। একে যদি এতক্ষণে সরিয়ে ফেলা হয়ে থাকে তবেই সর্বনাশ। কোনও কিছুকে ভিত্তি করে এগিয়ে যাবার পথ একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। আজ রাতেই সুলতাকে সরিয়ে ফেলবে বলছিল কবীর চৌধুরী। যেমন করেই হোক ঠেকাতে হবে তাকে।
.
সুবীর বাবু বাইরে গেছে শুনে একটু অবাক হলো সুলতা রায়। ভাবল কাছেই কোথাও গেছে বুঝি। ঘরে ঢুকে দেখল টেবিলের উপর দুজনের খাবার সাজানো আছে। পাশে একটা চিঠি। ভাজটা খুলে দেখল তাতে লেখা:
লতা,
আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। সাড়ে দশটার মধ্যে না ফিরলে খেয়ে নিয়ে শুয়ে পোড়ো।
সুবীর
খিদেও লেগেছিল, আর সাড়ে দশটাও গিয়েছিল বেজে। খেয়ে নিল সুলতা। বাথরুমে গিয়ে ঠোঁট-মুখের প্রলেপ আর কপালের টিপ উঠিয়ে ফেলল সে। বিড়ে খোঁপা খুলে চুলগুলো আলতো করে পেচিয়ে নিল হাত-খোঁপায়।