ঠিক সেই সময়ে দূর থেকে একটা ইঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ শোনা গেল। সেই টিলার দিক থেকেই এল শব্দটা। ক্রমে দূরে মিলিয়ে গেল সেই শব্দ-ফিরে চলে গেল স্পীড-বোট। কিন্তু বুদ্বুদ উঠছেই।
.
কাপ্তাইয়ের পাঁচ মাইল উত্তর-পশ্চিমে হাতের বামদিকে একটা মাটির টিলা-এখন রিজারভয়েরের পানি বেড়ে ওঠায় ডুবু ডুবু। তারই ভিতর দামি আসবাবপত্রে সুসজ্জিত একটা প্রশস্ত ঘর। একটা সোফায় বসে আছেন গৃহস্বামী কবীর চৌধুরী আর অপর একখানায় ভারতীয় গুপ্তচর বিভাগের একজন উচ্চপদস্থ মাদ্রাজী কর্মকর্তা মি. গোবিন্দ রাজলু। পাশের টিপয়ের উপর চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে গোবিন্দ রাজলু বলল, ‘অসামান্য আপনার প্রতিভা, মি. চৌধুরী। এই পাহাড়ের মধ্যে এত বড় একটা গবেষণাকেন্দ্র তৈরি করলেন কী করে? এতসব যন্ত্রপাতি, এত রকম ব্যবস্থাপনা! অথচ বাইরে থেকে কিছুই বুঝবার উপায় নেই।
এই অকুণ্ঠ প্রশংসায় কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে চৌধুরী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার। চাইল রাজলুর চোখের দিকে, তারপর বলল, আপনার প্রস্তাবে আমি রাজি আছি, মি. রাজলু। বেশ, শুক্রবারেই ঘটবে মহাপ্রলয়।, দেয়ালের গায়ে দুটো তাকের উপর থরে থরে সাজানো রয়েছে বই। চৌধুরী উঠে গিয়ে একটা বোতাম টিপতেই দেয়ালের খানিকটা অংশ ঘুরে গেল। বইসুদ্ধ সামনের দিকটা অদৃশ্য হয়ে গেল পিছনে, আর পিছন দিক থেকে সামনে চলে এল একটা সিসিটিভি, অর্থাৎ ক্লোজড-সার্কিট টেলিভিশন সেট। সেটটা চালু করে দিয়ে নিজের আসনে গিয়ে বসল চৌধুরী। গোবিন্দ রাজলু অবাক হয়ে দেখল পরিষ্কার কাপ্তাই ড্যামের ছবি দেখা যাচ্ছে টেলিভিশনে। এক আধটা গাড়ি সাঁ করে চলে যাচ্ছে বাঁধের ওপরের রাস্তাটা দিয়ে। সামনে থৈ-থৈ করছে জল, অল্প বাতাসে ছোট ছোট ঢেউ উঠছে সে জলে।
‘রিজারভয়েরের জল এখন কতখানি?’ জিজ্ঞেস করল রাজলু।
সী-লেভেল থেকে ৯৯ ফুট। এটা সারভে অভ পাকিস্তানের হিসাব। ড্যামের হিসাব অবশ্য আলাদা-ওরা সী-লেভেলের নয় ফুট নীচ থেকে ধরে। ওরা বলবে এখন ১০৮ ফুট।
আচ্ছা, পুরো ড্যামের ফিল ম্যাটেরিয়াল কতখানি? মাত্র তিনটেতেই কাজ হয়ে যাবে বলে মনে করেন?
‘ফিল ম্যাটেরিয়াল হচ্ছে পনেরো কোটি ছেষট্টি লক্ষ আশি হাজার সিএফএস। হ্যাঁ, আমার মতে তিনটেই যথেষ্ট। মেইন ড্যামটা দু’হাজার দুশো ফুট লম্বা; আর চওড়া হচ্ছে, ওপরটা বাইশ ফুট-নীচটা এক শ’ পয়তাল্লিশ ফুট। তিনটে জায়গা ভেঙে দিতে পারলে বাকিটা আপনিই উড়ে যাবে। তা ছাড়া দেখুন, স্পিলওয়ের ষোলোটা গেট-প্রতিটা বত্রিশ বাই চল্লিশ ফুট-আমার লোক সব কটা। লক গেট সম্পূর্ণ খুলে দিয়ে সরে পড়বে সবাই যখন প্রেসিডেন্টের ওপেনিং নিয়ে ব্যস্ত, সেই সুযোগে। এ ছাড়াও পাওয়ার হাউসের টানেল ডায়ামিটার হচ্ছে বত্রিশ ফুট হরস শূ-সেখান দিয়েও বেরোচ্ছে পানি। সবটা মিলে মোট এফেক্ট হচ্ছে এক কথায় যাকে বলে ডিভাসটেটিং… ভয়ঙ্কর। পুরো রিজারভয়ের, অর্থাৎ দুশো তেপ্পান্ন বর্গমাইলের এতদিনকার জমা পানি একসঙ্গে বেরোবার চেষ্টা করছে-কল্পনা করুন একবার। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন মি. রাজলু, এই তোড়ের মুখে প্রেসিডেন্টের চিহ্নমাত্রও খুঁজে পাওয়া যাবে না, পাক-চীন প্যাক্ট নিয়েও ভারতকে আর মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হবে না।’
‘আমাকে আপনি আশ্চর্য করে দিচ্ছেন, মি. চৌধুরী। ভয়ানক নিষ্ঠুর লোক আপনি, মশাই। এত সাংঘাতিক একটা কাজ এমন ঠাণ্ডা মাথায় কী করে করছেন। আপনি? এতটুকু বিকার নেই। লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে একবারও কি দ্বিধা হচ্ছে না, কিংবা হচ্ছে না এক বিন্দু বিবেক-দংশন?
‘দেখুন, সে অনেক কথা। আমাদের কারও হাতেই অত সময় নেই যে এ নিয়ে দীর্ঘ আলাপ করব। তবু এটুকু আপনাকে বলতে পারি যে এমন হঠাৎ করে যদি প্রয়োজন হয়ে না পড়ত তা হলে হয়তো এত প্রাণ নষ্ট না করে অন্য উপায় অবলম্বন করতাম আমি। কেবল মাত্র আকস্মিক প্রয়োজনের তাগিদেই আপনাদের সাহায্য নিতে হচ্ছে আমাকে-এবং কেবলমাত্র এই জন্যেই প্রজেক্ট ওপেনিং-এর দিন ড্যাম ভাঙার গহিত প্রস্তাব আমাকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও মেনে নিতে হলো।’
কথার ফাঁকে ফাঁকে বাঁকা পাইপটায় টোবাকো ভরা হচ্ছিল, এবার সেটা ধরিয়ে নিয়ে টেলিভিশন সেটের একটা নব সামান্য ঘুরিয়ে ছবিটা আরও পরিষ্কার করে দিল কবীর চৌধুরী। তারপরই কী দেখে চমকে উঠে ‘এক্সকিউজ মি,’ বলে একপাশে টেবিলের উপর রাখা ওয়ায়েরলেস ট্রান্সমিটারের সামনে গিয়ে বসল।
হঠাৎ চৌধুরীকে একটু ব্যস্ত হয়ে উঠতে দেখে বিস্মিত গোবিন্দ রাজলু টেলিভিশনের দিকে চেয়ে দেখল তাতে দেখা যাচ্ছে একজন মার্কিন সাহেবকে। হাত নেড়ে কাউকে কিছু নির্দেশ দিচ্ছে সে-বাঁধের কাছেই জলের মধ্যে কিছু লক্ষ্য করছে সাহেব টর্চ জ্বেলে।
কানে এয়ার ফোন লাগিয়ে ইলেভেন মেগাসাইকেলসে সিগনাল দিল চৌধুরী।
‘এক্স ওয়াই জেড কলিং এসবি টু, ক্যান ইউ হিয়ার মি?’ দুবার বলল কথাটা চৌধুরী।
‘এসবি টু স্পীকিং। হিয়ার ইউ লাউড অ্যাণ্ড ক্লিয়ার।’ সঙ্গেসঙ্গেই উত্তর এল, স্পীড-বোট থেকে।
‘তেরো নম্বরকে বোটে ফিরিয়ে আনো-সিগনাল দাও।’
খানিকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর উত্তর এল, ‘আমাদের সিগনাল পাচ্ছে না। তেরো নম্বর-অনেক দূর চলে গেছে। এগিয়ে যাব সামনে?