ফোনটা নামিয়ে রেখে রানার দিকে চেয়ে একটু হাসল মি. চৌধুরী।
‘আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে বড় খুশি হলাম, মি. মাসুদ রানা। দেয়ালের ওপর অমন ভয়ানক শক্ খেলেন, তবু আমাদের লোক আপনাকে খুঁজে পাওয়ার আগেই ঢুকে পড়লেন বাড়ির ভেতর। ভাবছিলাম কার এতবড় দুঃসাহস? এখন পরিষ্কার হয়ে গেল সবকিছু। আমি অত্যন্ত দুঃখিত (যদিও চেহারা দেখে একটুও দুঃখিত মনে হলো না তাকে), মৃত্যুর চাইতে হাল্কা আর কোনও দণ্ড আপনাকে দিতে পারছি না, মি. মাসুদ রানা। তবে সাহসী লোকের প্রতি আমার কিছুটা দুর্বলতা আছে… আমি চেষ্টা করব আপনার জন্যে যতদূর সম্ভব বেদনাহীন মৃত্যুর ব্যবস্থা করতে।
‘আমার মৃত্যু হলেই মনে করেছ তুমি পার পেয়ে যাবে?
রানার কথার কোনও জবাব না দিয়ে লম্বা লোকটাকে কবীর চৌধুরী বলল, ‘একে ঠাণ্ডা ঘরের পাশের কুঠুরীতে আটকে রাখো, ইয়াকুব। ভোর চারটেয় আমি ল্যাবরেটরিতে ফিরে যাব, তখন ওকে হাত-পা-মুখ বাধা অবস্থায় গাড়ির পেছনে তুলে দেবে। এখন যাও। সাবধান থাকবে। যদি বেশি অসুবিধার সৃষ্টি করে, শেষ করে দেবে।
একটা অশ্লীল গালি বেরিয়ে এল রানার মুখ দিয়ে।
বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাঁড়াল কবীর চৌধুরী। সপাং করে একটা চাবুকের বাড়ি পড়ল রানার কাঁধের উপর। চমকে উঠল রানা। ততক্ষণে আবার নেমে আসছে। চাবুক। ডান হাতে ধরে ফেলল রানা চাবুকটা, কিন্তু এক হেঁচকা টানে কবীর চৌধুরী ছিনিয়ে নিল সেটা। স্টিং রে বা স্থানীয় ভাষায় শঙ্কর মাছের লেজের চাবুক। হাতের তালুর পোড়া জায়গাটার উপর দিয়ে জোরে ঘষতে ঘষতে বেরিয়ে গেল সেটা মুঠো থেকে। অবর্ণনীয় ব্যথায় নীল হয়ে গেল রানার মুখ। একটা চাপা আর্ত চিৎকার বেরিয়ে পড়ল মুখ দিয়ে। হাতের রুমালটা লাল হয়ে গেল রক্তে।
বেয়াদবির শাস্তি!’ বলে কবীর চৌধুরী মাথা নেড়ে ইঙ্গিত করল ইয়াকুবকে।
দাঁড়িয়ে পড়েছিল রানা। ইস্পাত কঠিন দুটো হাত এসে ওর ডান হাতটা ধরে মুচড়ে পিঠের দিকে নিয়ে গিয়ে উপরে ঠেলতে লাগল। রানার মনে হলো হাতটা ভেঙে যাবে। ব্যথায় গলা দিয়ে একটা অদ্ভুত গোঙানি মত শব্দ বেরোল ওর। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠল কপালে।
‘এগোও।’ একটা ঠেলা দিল ইয়াকুব পিছন থেকে।
রানার পা এলোপাথাড়ি পড়তে লাগল। দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে ওরা একটা লম্বা বারান্দায় পড়ল। দুপাশে দেয়াল।
‘হাতটা ভেঙে যাবে! উঃ! আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি!’ কাতর স্বরে বলল রানা। হাতটা একটু আলগা হোক, তাই চাচ্ছে ও।
‘চোপ, শালা!’ ধমকে উঠল ইয়াকুব, কিন্তু কব্জিটা ইঞ্চি তিনেক নামিয়ে দিল পিঠের উপর। রানা ভাবছিল, তলপেট, কণ্ঠনালী বা অণ্ডকোষ-এই তিন জায়গা, হচ্ছে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দুর্বলের লক্ষ্যস্থল।
ইচ্ছে করেই একবার হোঁচট খেল। ইয়াকুবের গায়ের সঙ্গে ধাক্কা লাগল ওর। আন্দাজ পাওয়া গেল দুজনের মধ্যের দূরতুটা ঠিক কতখানি।
এবার হঠাৎ রানা ডানধারে একটু সরে গেল এবং বাঁ হাতটা সটান সোজা রেখে খুব জোরে পিছন দিকে চালাল। ধাই করে হাতটা লক্ষ্যবস্তুর উপর পড়তেই তীক্ষ্ণ একটা শব্দ বেরোল ইয়াকুবের মুখ থেকে। ডান হাতটা ঢিল পেয়ে পিঠের উপর থেকে নামিয়ে আনল রানা। ইয়াকুব ততক্ষণে যন্ত্রণায় বাঁকা হয়ে গেছে। দুই হাত দিয়ে সে দুই উরুর মাঝখানে কী যেন চেপে ধরেছে। দু’পা পিছিয়ে গিয়ে প্রচণ্ড এক লাথি মারল রানা ওর পাজরের উপর। ছিটকে গিয়ে পাশের দেয়ালে পড়ল লোকটা-ভয়ানক জোরে মাথাটা ঠুকে গেল দেয়ালের সঙ্গে। অজ্ঞান হয়ে পড়ে, যাচ্ছিল ইয়াকুব, মড়ার উপর খাড়ার ঘায়ের মত মাসুদ রানার প্রচণ্ড লেফট কাট এসে পড়ল ওর নাকের উপর।
ইয়াকুবের লম্বা দেহটা সটান মাটিতে পড়তেই রানা চোখ মুখের ঘাম মুছে নিল হাতের পিছন দিক দিয়ে, তারপর ইয়াকুবের পকেট থেকে নিজের ওয়ালথারটা বের করে নিল। যেদিকে ওকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সেদিকেই এগোল রানা। কয়েক পা যেতেই পিছন থেকে দোতলার উপর যে লোকটা রানাকে প্রথম ধরেছিল, তার কণ্ঠস্বর শোনা গেল। সেই আগের মতই বলে উঠল লোকটা, হ্যাণ্ডস আপ!
পিস্তল ধরাই ছিল হাতে, এক নিমেষে ঘুরে দাঁড়িয়ে গুলি করল রানা। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল লোকটা, মুখটা খোলাই থাকল, আওয়াজ বেরোল না। দুহাতে নিজের বুকটা চেপে ধরল সে। তারপর ঢলে পড়ে গেল মাটিতে। হাতের রিভলভারটা থেকে একটা গুলি ছুটে বেরিয়ে ছাতে গিয়ে লাগল কিছুটা চুন-সুরকি খসে পড়ল ওর মৃতদেহের উপর পুস্পবৃষ্টির মত।
এবার সামনের দিকে ছুটল রানা। যেভাবে হোক বেরোতে হবে এখান। থেকে। পিস্তল আর রিভলভারের আওয়াজ এতক্ষণে নিশ্চয়ই বাড়ির আর সবার কানে গেছে।
বারান্দাটা কিছুদূর সোজা গিয়ে আবার বাম দিকে মোড় নিয়েছে। আরও খানিকটা গিয়ে দেখা গেল সামনে দেয়াল, আর পথ নেই। কায়দা জানাই ছিল, যে কটা বোতাম পেল হাতের কাছে সব এক এক করে টিপতে আরম্ভ করল। হঠাৎ দেয়ালটা ফাঁক হয়ে গেল ‘ওপেন সিসেমে’র মত। একটা বড় হলঘর। ঘরে ঢুকেই রানা বুঝতে পারল এই ঘরেই সুলতা বসে ছিল কিছুক্ষণ আগে। টেবিলের উপর থেকে ডিনামাইটগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। হঠাৎ ঘরের একপাশ থেকে কেউ কথা বলে উঠল, ‘মাসুদ রানা, যেখানে আছ সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ো। এক পা নড়লেই মারা পড়বে।