‘আপনিও মিথ্যে বকর বকর না করে চিঠিটা পড়ে দেখুন, মি. চৌধুরী। তারপর আমাকে যেতে দিন।
‘চিঠিটা পড়ে দেখলেও আপনাকে যেতে দেয়া হবে না। এ বাড়িতে ঢোকা যদিও একেবারে অসম্ভব নয়-কারণ দেখতেই পাচ্ছি আপনি ঢুকেছেন–কিন্তু এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া সত্যিই অসম্ভব।
তার মানে?
মনে হচ্ছে, আজ আর সুলতা দেবীর সঙ্গে রাত কাটানো আপনার কপালে নেই, সুবীর বাবু। কেবল একটা চিঠিতে কিছুই প্রমাণ হয় না। তা ছাড়া আপনার কথায় অনেক গোলমাল আছে। শুনুন। আপনি বলছেন, হেড অফিসের হুকুমে। আপনি এবাড়িতে প্রবেশ করেছেন। অথচ আপনার হেড অফিস আমার বাড়ির দেয়ালের ওপর ইলেকট্রিক তারের অস্তিত্ব সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল থাকা সত্ত্বেও আপনাকে সাবধান করে দেয়নি–এ কেমন কথা? তার ওপর আপনার জুতো জোড়া। ঘরের এক কোণের দিকে চাইল চৌধুরী। রানাও দেখল একটা টী-পয়ের। উপর সাজানো রয়েছে ওর জুতো জোড়া। ওগুলো ঢাকার বিউটি ফুট ওয়্যারের তৈরি। ওগুলোর গোড়ালিতে যে চোরা কুঠুরী আছে তার মধ্যে রাখা ছুরিটা বিশেষ কায়দায় তৈরি হয়েছে শিয়ালকোট থেকে। ভারতীয় গুপ্তচরের এসব গুপ্ত জিনিস কি আজকাল পাকিস্তান সাপ্লাই দিচ্ছে?’
‘দেখুন, আপনি মিথ্যে আমাকে সন্দেহ করছেন। আমি…’
বাধা দিয়ে গর্জে উঠল কবীর চৌধুরী, ‘মিথ্যে আমি কাউকে সন্দেহ করি না, সুবীর বাবু। রাস্তার উপর যে ওপেল রেকর্ড রেখে এসেছেন সেটা পিসিআই-এর। চিটাগাং-এজেন্ট আবদুল হাইয়ের। আপনি বলতে চান পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ভারতীয় সিক্রেট সার্ভিসকে পূর্ব পাকিস্তানের এক মহা ধ্বংসলীলায়। সাহায্য করছে? সেটা সম্ভবপর হলে আমি এদের কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করতাম, ভারত সরকারের কাছে হাত পাততে হত না। বুঝতে পারছেন আমার কথা? এখন বলুন, আপনার পরিচয়?
চুপ করে থাকল রানা। এর চোখে ধুলো দেয়া সহজ কথা নয়।
‘চুপ করে থেকে কোনও লাভ নেই, সুবীর বাবু। কথা আপনাকে বলতেই হবে-এবং সত্যি কথা। এর উপর নির্ভর করছে আপনার জীবন মরণ। দেখুন, আমি বৈজ্ঞানিক মানুষ, এখন এক ভয়ঙ্কর খেলায় নেমেছি। যে-কোনও রকম বাধা অতিক্রম করবার ক্ষমতা আমার আছে। আপনি যদি সত্যি কথা বলেন, তবে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর হাত থেকে আপনার বাঁচবার একটু ভরসা থাকতেও পারে। মিছেমিছি প্রাণী হত্যা আমি পছন্দ করি না। আমার পরিকল্পনার সুষ্ঠু বাস্তবায়নে আপনি কতটুকু ক্ষতিকর ভূমিকা নিতে পারেন তা জানতে পারলে ঠিক সেই পরিমাণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। হয়তো এমনও হতে পারে, মাত্র কয়েকটা হাড়গোড় ভেঙে আপনাকে বর্মা মুলুকে সরকারী পুলিশের হাতে ছেড়ে দিয়ে আসা হলো। সেখান থেকে নাকানি’ চুবানি খেয়ে দেশে ফিরতে ফিরতে কয়েক মাস লেগে যাবে-কয়েক বছরও লাগতে পারে, কিন্তু প্রাণে তো বাঁচলেন! কথা না বললে সবচাইতে সহজ পথটাই বেছে নিতে হবে আমাদের।’
এ পাইপটা নিভে গিয়েছিল। আবার ধরিয়ে নিল কবীর চৌধুরী। কিছুক্ষণ মগ্ন চিত্তে পাইপ টানার পর আবার বলল, আর আপনার ভাগ্যক্রমে যদি কাল সকালে সুলতা দেবী এসে আপনাকে সুবীর সেন বলে সনাক্ত করেন তবে আপনার একটা মধু-রাত্রি মাটি করে দেয়ার জন্যে আমরা আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করে আপনাকে সসম্মানে মুক্তি দেব।’
‘এখুনি মিসখায় টেলিফোন করে সুলতাকে ডেকে পাঠান না।’ এতক্ষণে একটু আশার আলো দেখতে পেল রানা।
‘এত রাতে বিরক্ত করা কি ঠিক হবে? আচ্ছা, বেশ। আপনি যখন হোটেলে ফিরবার জন্যে এত উতলা হয়ে পড়েছেন, তখন দেখছি ফোন করে।
রিসিভার তুলে ডায়াল করল কবীর চৌধুরী। রানা আরেকটা সিগারেট ধরাল। পিছনে চেয়ে দেখল ওর ওয়ালথার পিপিকে-টা আলগাভাবে হাতের মুঠোয় ধরে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে অস্থিসর্বস্ব লম্বা লোকটা। রিভলভারধারী কখন যেন কবীর চৌধুরীর গোপন ইঙ্গিতে নিঃশব্দে সরে গেছে পিছন থেকে।
‘হোটেল মিসখা? …সুলতা দেবীকে ডেকে দিন তো দশ নম্বর রুম থেকে। …না তো, একটু আগে আমি রিং করিনি। …নেই? (কপালটা একটু কোঁচকাল কবীর চৌধুরী) …বাবুর সঙ্গে বেরিয়ে গেছে? কখন? …আচ্ছা ঠিক আছে।’
রানা ভাবছে, এতক্ষণে তো হোটেলে পৌঁছে যাবার কথা। পরমুহূর্তে মনে পড়ল, এ নিশ্চয়ই হাসান আলীর কাজ। টেলিফোন এলে কী করতে হবে ও নিজেই বলে দিয়েছিল তাকে …হোটেলে তা হলে একটু আগে কেউ ফোন করেছিল? কোথা থেকে টেলিফোন! তবে কি তার পরিচয় প্রকাশ পেয়ে গেছে? সুলতাকে যখন চেয়েছিল ফোনে তখন নিশ্চয়ই তাকে সাবধান করে দেয়ার জন্যে ইণ্ডিয়ান সিক্রেট সার্ভিসের কেউ করেছিল এই ফোন।…এখানেও তো ওরা ফোন করে জানাবে তা হলে! কোনও ভাবে খবরটা আটকানো যায় না? ফোনের তারটা ছিঁড়ে ফেললে কেমন হয়? ফোনটা হাতে পাওয়ার জন্যে বলল রানা, সুলতা হোটেলেই আছে। আমিই ওকে নিষেধ করেছি বাইরের কারও ফোন ধরতে। আমাকে দিন; আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি।’
টেলিফোনটা কবীর চৌধুরী এগিয়ে দিতে যাবে এমন সময় রানাকে চমকে দিয়ে বেজে উঠল টেলিফোন। ক্রিং ক্রিং…ক্রিং ক্রিং..
কবীর চৌধুরী বলছি। …আচ্ছা, বলুন! …কে, সুলতা? এই কিছুক্ষণ আগে হোটেলে ফিরে গেল। …কী বললেন? সুবীর সেন ঢাকার আর্মি হাসপাতালে? তবে সুলতাকে বসন্তপুর থেকে আনল কে? …মাসুদ রানা? (চট করে একবার রানার ফ্যাকাসে মুখের উপর চোখ বুলিয়ে নিল কবীর চৌধুরী, তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ মন দিয়ে শুনল ফোনের কথাগুলো।) …বুঝলাম, কিন্তু পিসিআই কেবল চিঠিটা দেখে আর কী বুঝবে? এখানে কী হচ্ছে বা হতে চলেছে তার কিছুটা জানতে পেরেছে কেবল মাসুদ রানা। আপনাদের অত চিন্তার কোনও কারণ নেই। মাসুদ রানা এখন আমার হাতে বন্দি। কাল ভোরে এ পৃথিবীর জ্বালা-যন্ত্রণা থেকে ওকে চিরতরে মুক্তি দেব …হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার এলাকায় আমি যে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সক্ষম। …নিশ্চিন্ত থাকুন, সুলতা নিরাপদে কলকাতা পৌঁছবে, আজ রাতেই সরিয়ে ফেলব ওকে মিসখা থেকে …ঠিক আছে, সমস্ত দায়িত্ব আমি নিলাম।’