‘আসুন, আসুন! বসুন। নরম স্বাভাবিক গলায় আপ্যায়ন করল কবীর চৌধুরী। যেন কিছুই ঘটেনি, এমনি ভাব।
পুরু কার্পেটের উপর দিয়ে নিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে বসানো হলো রানাকে ডেস্কের দিকে মুখ করে।’হাতটা ছেড়ে দিল লম্বা লোকটা। রানাও যেন হাঁফ ছেড়ে বাচল। হাতের মধ্যে রক্ত চলাচল বন্ধ ছিল এতক্ষণ। হাত দুটো ঝুলিয়ে রাখল রানা চেয়ারের হাতলের দুই পাশে। চিনচিনে মৃদু ব্যথার সঙ্গে আবার রক্ত চলতে শুরু করল।
কোনও কথা না বলে কবীর চৌধুরী আপাদমস্তক লক্ষ্য করছিল রানাকে। দৃষ্টিটা স্থির এবং একাগ্র। মনে হলো যেন অন্তস্তল ভেদ করে বেরিয়ে গেল সে দৃষ্টি। যেন কিছুই এর নজর থেকে গোপন রাখার উপায় নেই। ঝিরঝির করে এয়ার কণ্ডিশনারের একটা মৃদু গুঞ্জন আসছে ঘরের এক কোণ থেকে। এই প্রথম রানা অনুভব করল অত্যাশ্চর্য এক ব্যক্তিত্ব। চোখে মুখে চেহারায় সবদিক থেকে যেন প্রতিভা এবং শক্তির বিচ্ছুরণ হচ্ছে। অদ্ভুত প্রাণবন্ত একটা মানুষ। মস্তবড় মাথা ভর্তি কোকড়া চুল তেলের অভাবে কিছুটা রুক্ষ। বয়স পয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ হবে।
রানা লক্ষ করল কবীর চৌধুরীর গায়ের রঙটা তিনদিনের পানিতে ডোবা প্রায় পচে ওঠা মড়ার মত। যেন বহুদিন মাটির নীচে কোনও তলকুঠুরির সোদা আবহাওয়ায় কাটিয়েছে, বাইরের আলো-বাতাসের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত।
টেট্রনের কোটটা খুলে একটা হ্যাঁঙ্গারে ঝোলানো। সাদা স্টিফ কলার শার্টের নীচে গেঞ্জির অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে কয়েকটা বাঁকা রেখায়। অনামিকায় মস্ত বড় একটা হীরের আংটি উজ্জ্বল আলোয় ঝিমি করছে। জুলফির কাছে কয়েকটা পাকা চুল আভিজাত্য এনেছে চেহারায়।
কিছুক্ষণ চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে রানাকে লক্ষ্য করল মি. চৌধুরী। রানাও পাল্টা লক্ষ্য করল তাকে খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, তারপর ঘরের চার ধারে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। সৌখিন কোটিপতির লাইব্রেরি যেন, সাজানো গোছানো ঠাণ্ডা ও নীরব এই ঘরটা। বোধহয় সাউণ্ড-প্রফ করা। থরে থরে সরু, মোটা অনেক বই সাজানো বারো চোদ্দটা বড় বড় আলমারিতে। কবীর চৌধুরীর ঠিক মাথার উপর পিছনের দেয়ালে টাঙানো স্বামী বিবেকানন্দের মস্ত একটা অয়েল পেইন্টিং।
রানা ভাবছিল, এই লোকটাই কি সেই বিখ্যাত চৌধুরী জুয়েলার্সের মালিক? তবে এর বাড়িতে অত বড় গুদাম ঘর কীসের? বাড়িটা এমন ভাবে সুরক্ষিত করবার কী দরকার? ভারতীয় গুপ্তচর বিভাগের সঙ্গে এর কী সম্পর্ক? তার উপর স্বামী বিবেকানন্দের ছবি, অ্যাডভান্সড ফিজিক্সের বই। ঠিক সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
সিগারেট কেসটা বের করবার জন্যে পকেটে হাত দিতে গেল রানা। কথা বলল কবীর চৌধুরী।
‘সিগারেট খেতে পারেন আপনি। কিন্তু অন্য কোনও উদ্দেশ্য থাকলে সাবধান হতে অনুরোধ করছি। প্রতিটি মুহূর্ত আমি প্রস্তুত আছি আপনার জন্যে। ফলটা আপনার জন্য শুভ হবে না।’
বৃথা হুমকি দেবার লোক কবীর চৌধুরী নয়। বাড়িটায় ঢুকে এতক্ষণ পর্যন্ত যা দেখেছে, তাতে অনেকখানি পরিষ্কার হয়ে গেছে রানার কাছে-এ লোকের প্রতিটা খুঁটিনাটি ব্যবস্থায় অসামান্য বুদ্ধিমত্তার পরিচয় আছে, এবং সেই সঙ্গে আছে প্রচণ্ড ক্ষমতার ইঙ্গিত।
একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান দিল রানা।
‘আপনার নাম?’ রানার চোখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল কবীর চৌধুরী। যেন একবিন্দু মিথ্যে বললেই ধরে ফেলবে।
সুবীর সেন।
পলকের জন্যে ভুরু জোড়া একটু কোঁচকাল কবীর চৌধুরী। তারপর স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ইণ্ডিয়ান সিক্রেট সার্ভিসের সুবীর সেন?
‘আজ্ঞে, হ্যাঁ।
‘সুলতা রায়কে আপনিই গাড়িতে তুলে নিয়ে এসেছেন বসন্তপুর থেকে?
‘আজ্ঞে, হ্যাঁ।’
‘তা, কী কারণে এই গরিবালয়ে পদার্পণ?’
‘হেড অফিসের হুকুম।
‘বিশ্বাস করলাম না আপনার কথা।
বিশ্বাস করাবার মত যুক্তি আমার পকেটে আছে, মি. চৌধুরী।
পকেট থেকে একখানা কাগজ বের করল রানা। টেবিলের উপর ছুঁড়ে দিল। সেটা। কবীর চৌধুরী একবার চোখ বুলাল সাঙ্কেতিক চিঠিটার উপর। এবার আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল তার চোখ দুটো।
‘এ চিঠির আদৌ যদি কোনও অর্থ থাকে, তবে তা বের করে নিতে আমার পনেরো মিনিট সময় লাগবে। যাক, আপাতত ধরে নিলাম আপনি সুবীর সেন। কিন্তু আমার বাড়িতে অনধিকার প্রবেশ করেছেন কেন?’ চিঠিটা ভাজ করে টেবিলের উপর পেপার-ওয়েট দিয়ে চাপা দিয়ে রাখল কবীর চৌধুরী।
সুলতা রায়কে অনুসরণ করবার আদেশ আছে আমার উপর। ডিনামাইটগুলো ঠিক হাতে পৌঁছল কি না এবং ঠিকমত ব্যবহার করা হলো কি না সেটা দেখার ভার দেয়া হয়েছে আমাকে। তাই গাড়ির মধ্যে লুকিয়ে সুলতার সঙ্গেই ঢুকেছি এ বাড়িতে।
‘সুলতার গাড়িতে আপনি আসেননি-এসেছেন ওপেল রেকর্ডে করে। কবীর চৌধুরীর হাসি হাসি মুখটা গম্ভীর থমথমে হয়ে গেল। মনে হলো রানার মুখের উপর কেউ যেন দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল। তীব্র দৃষ্টিতে রানার চোখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, ‘মিছে কথা আমি বরদাস্ত করি না, সুবীর বাবু। আপনি ভুল করছেন। মিথ্যে বলে আজ পর্যন্ত আমার হাত থেকে কেউ নিস্তার। পায়নি। আপনিও পাবেন না।’
টেবিলের উপর থেকে একটা পাইপ তুলে নিয়ে চামড়ার পাউচ থেকে টোবাকো, ভরে নিল কবীর চৌধুরী। একটা লাইটার দিয়ে সেটা ধরিয়ে আঙুল দিয়ে টিপে আগুনটাকে সব জায়গায় সমানভাবে ছড়িয়ে দিল। তারপর একগাল ধোয়া ছেড়ে বলল, রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটা তো বটেই, আপনার ডান হাতটাও প্রমাণ করছে যে আপনি সুলতার সঙ্গে আসেননি, দেয়াল টপকাতে গিয়ে প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেয়েছেন ইলেকট্রিসিটির। আমি তখন এখানে ছিলাম না। হঠাৎ বাতির আলো কমে যাওয়ায় এ বাড়ির কারও কাছেই আপনার আগমন গোপন ছিল না। তবে এরা ভাবতেও পারেনি যে ভাগ্যক্রমে নর্দমাটা পেয়ে যাবেন। আপনি। এতক্ষণে সে পথটা বন্ধ করা হয়ে গেছে। এ বাড়িতে আপনার প্রতিটি পদক্ষেপ আমরা লক্ষ করেছি। কাজেই মিথ্যে কথা না বাড়িয়ে বলে ফেলুন আপনি কে, এবং কেন এ বাড়িতে প্রবেশ করেছেন।’