পিছনের একটা ব্ল্যাক বোর্ডের সামনে উঠে গিয়ে দাঁড়াল সুলতা। সাদা চক দিয়ে তার উপর একটা ডায়াগ্রাম আঁকল। তারপর লাল চক দিয়ে তিনটে জায়গায়। গোল চিহ্ন দিল। রানা বুঝল, এবার বোঝানো হচ্ছে ঠিক কোন জায়গায়। ডিনামাইটগুলো বসাতে হবে।
নক্সাটা দেখে কিছুই বোঝা গেল না। চেষ্টা করেও রানা কোনও কিছুর সঙ্গে এর মিল খুঁজে পেল না। ছবিটা যত্ন করে মনের মধ্যে গেঁথে নিল ও, ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে।
আবার সোফায় এসে বসল সুলতা। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর একজন একটা নোট বই এগিয়ে দিল, তাতে কী সব লিখে দিল সুলতা।
হঠাৎ সুলতার সামনের লোক দুজন উঠে দাঁড়াল। রানা চেয়ে দেখল সুলতার পিছনের একটা দরজা দিয়ে ভারী পর্দা উঠিয়ে ঘরে ঢুকল সাড়ে ছ’ফুট লম্বা এবং সেই পরিমাণে চওড়া একজন লোক। কাঁধের উপর প্রকাণ্ড একটা মাথা, মাথা ভর্তি কোকড়া চুল ব্যাকব্রাশ করা। অত্যন্ত সুপুরুষ চেহারা। পরনে কড়া ইস্তিরির রুচিসম্পন্ন টেট্রন সুট। লোকটা ঘরে ঢুকল ডান-পা-টা একটু টেনে টেনে।
সুলতা উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল, লোকটা ওকে বসতে বলে অপর দু-জনকেও বসবার ইঙ্গিত করল। তারপর নিজে সুলতার পাশে বসে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করল। সামনের একজনকে কিছু একটা আদেশ করতেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
এবার বিদায় গ্রহণের পালা। সাড়ে দশটা বাজে। সুলতা উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করল। মিষ্টি হেসে তাকে বিদায় দিতে এগিয়ে গেল নতুন আগন্তুক।
সুলতা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই পা টিপে আবার দোতলায় চলে এল রানা। গাড়ি-বারান্দার ঠিক মাথার উপরের ব্যালকনিতে একটা মোটা থামের আড়াল থেকে শুনল গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে উঁচু গলায় সুলতা বলছে, ‘গেটটা কাউকে একটু খুলে দিতে বলুন, মি. চৌধুরী।
‘আপনি রওনা হন। এখান থেকে বোতাম টিপলে আপনিই খুলে যাবে গেট, ভারী গলায় উত্তর এল।
রানা ভাবল সুইচটা কোথায় আছে দেখতে পেলে হতো। কিন্তু তখন আর নীচে নামার সময় নেই।
সামনেটা আলোকিত করে গেটের কাছে চলে গেল ফোক্সভাগেন। গেটটা খুলে ভিতর দিকে ভাজ হয়ে গেল। হেডলাইটের আলোয় রানা পড়ল গেটের উপর প্লাস্টিকের নেম প্লেটে লেখা:
কবির চৌধুরী
২৫৭ বায়েজিদ বোস্তামী রোড
চিটাগাং।
গাড়িটা বেরিয়ে যেতেই লোহার গেট বন্ধ হয়ে গেল। ক্লিক করে একটা তীক্ষ্ণ শব্দ করে তালা লেগে গেল গেটে। রানা ভাবল, আপাতত কাজ শেষ। কালকে শুরু হবে আসল কাজ। এখন আবার পাইপ বেয়ে নামা, ড্রেন গলে বেরিয়ে হোটেলে ফেরা। ফোঁস করে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়াল ও।
‘হ্যাণ্ডস আপ!’
চমকে উঠল রানা। উদ্যত রিভলভারের নলটার দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ও। তিন গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছে মি, চৌধুরীর আদেশে যে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল সেই লোকটা। রানা এক পা এগোতেই উজ্জ্বল বাতি জ্বলে উঠল ব্যালকনিতে। গর্জন করে উঠল লোকটা, খবরদার! আর এক পা এগিয়েছ কি গুলি করব। কোনও চালাকি চাই না। মাথার উপর হাত তুলে দাঁড়াও।’
ধীরে দু’হাত মাথার উপর তুলে ধরল রানা। ঠিক সেই সময় আরও দুজন লোক উঠে এল সিঁড়ি বেয়ে। একজনের উদ্দেশে লোকটা বলল, হাবীব, দেখো তো এর সঙ্গে কোনও অস্ত্রশস্ত্র আছে কি না।
হাবীব ও তার সঙ্গের লোকটা এগিয়ে এল রানার দিকে। রানা বুঝল, এই সুযোগ। রিভলভার থেকে যেই হাবীব ওর দেহটা আড়াল করেছে অমনি এক ঝটকায় পিস্তল বের করে ফেলল সে। কিন্তু ভীষণ বলশালী একটা হাত চেপে ধরল ওর কব্জি। হাবীবের পাশের লোকটা কব্জিটা ধরে বিশেষ কায়দায় একটা মোচড় দিতেই ঠিক শিশুর হাতের খেলনার মত রানার অটোমেটিক ওয়ালথারটা খসে পড়ে গেল মাটিতে। হাবীব ওটা তুলতে গেছে, হাঁটু দিয়ে ওর চিবুকে কায়দা। মত একটা লাথি মারতে গিয়ে থেমে গেল রানা। ঠিক হৃৎপিণ্ড বরাবর পিঠের উপর একটা তীক্ষ্ণ ছুরির ফলা অল্প একটু বিধল। ততক্ষণে রিভলভারের সামনের আড়াল সরে গেছে। হাবীবের সঙ্গের পাতলা-সাতলা লম্বা অথচ অসুরের মত বলশালী লোকটা রানার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘দুষ্টুমি করে না, খোকা। মারব।’
এই বিপদের মধ্যেও লোকটার রসিকতায় মৃদু হাসল রানা। ওর হাত দুটোকে পিছমোড়া করে সাঁড়াশীর মত চেপে ধরল লম্বা লোকটা। চেষ্টা করেও এক বিন্দু আলগা করতে পারল না রানা সে মুঠো। ঠেলতে ঠেলতে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে নীচতলার একটা দেয়ালের সামনে নিয়ে আসা হলো রানাকে। একটা বোতাম টিপতেই দেয়ালটা দু’ভাগ হয়ে গিয়ে একটা দরজা বেরিয়ে পড়ল। মাঝারী আকারের একটা ঘরের ভিতর চলে এল রানা। হাবীব রয়ে গেল বাইরে। লম্বা। লোকটার পিছন পিছন ঘরে ঢুকল রিভলভারধারী। পিছনে দেয়ালটা আবার জোড়া লেগে গেল।
লাইব্রেরিতে নিয়ে এসো।’ ভারী গলার আওয়াজ পাওয়া গেল ঘরের মধ্যে, কিন্তু কোনও লোকের দেখা নেই। এদিক ওদিক চেয়ে রানা দেখল দেয়ালের গায়ে স্পীকার বসানো আছে একটা।
ততক্ষণে তাকে আরেকটা দেয়ালের সামনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একই উপায়ে দরজা তৈরি হলো সে দেয়ালে। রানার মাথায় তখন অতিদ্রুত কয়েকটা চিন্তা ঘুরছে। এখান থেকে বেরোবার কৌশল উদ্ভাবনের চেষ্টা করছে ও।
একটা দামি সেক্রেটারিয়েট টেবিলের উপরটা পুরু সবুজ ভেলভেটে ঢাকা-তারই ওপাশে রিভলভিং একটা চেয়ারে বসে শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। কবীর চৌধুরী। সামনের টেবিলের উপর একটা মোটা ইংরেজি বই পড়তে পড়তে উল্টে রাখা। চট করে নামটা দেখে নিল রানা। এইচ.এ.লরেঞ্জ-এর লেখা ‘প্যাটার্ন অভ ইলেকট্রন্স।