শিকগুলো সহজেই বাঁকিয়ে বাড়িতে ঢোকা সম্ভব মনে করে হাত দিতে গিয়েও থমকে গেল রানা। যদি এতেও কারেন্ট থাকে! বোঝা যাবে কী করে? এবার আর ছিটকে পড়ার সম্ভাবনা নেই–নিশ্চিত মৃত্যু!
‘ম্যাও।’
চমকে উঠে দেখল রানা, বাড়ির ভিতর থেকে একটা বিড়াল এসে শিকের অপর পারে উঁকি দিচ্ছে। বাইরে চলাচল করবার এই সোজা পথ বের করে নিয়েছে ওটা। শিকের সঙ্গে আলস্যভরে দুবার গা ঘষে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। বিড়ালটা। রানার দিকে নিরুৎসুক দৃষ্টিতে চাইল একবার। তারপর পিঠের উপরটা দুবার চেটে নিয়ে একটা বুক ডন দিয়ে লাফিয়ে চলে গেল ডান ধারে।
নিঃসন্দেহ হয়ে এবার রানা বাঁ হাতে একটা শিক ধরে টান দিল। শিকগুলোর নীচের দিকটা একেবারে চিকন হয়ে গেছে মরচেতে খেয়ে গিয়ে, তাই বাঁ হাতেই অনায়াসে বাঁকিয়ে উপর দিকে উঠিয়ে দিল ও। হাতের মুঠো থেকে একরাশ লোহার গুড়ো ঝরে পড়ল। খুশি মনে এক এক করে সবকটা শিক বাঁকিয়ে তুলে দিল রানা উপর দিকে, তারপর ডানহাতে ওয়ালথারটা বাগিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল ভিতরে।
বাড়িটার পিছন দিকে মস্ত বড় কম্পাউণ্ড। টিনের ছাউনি দেয়া লম্বা একখানা। গুদাম ঘর দেখা গেল। তার সামনে সাত টনী দুটো লরি দাঁড়িয়ে আছে। একটা ফোর্ড, আরেকটা মার্সিডিস। লোকজনের সাড়া শব্দ নেই। শেডবিহীন একখানা একশো পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে গুদাম ঘরের এক কোণে বাইরের দিকে। নগ্ন। দেখাচ্ছে ওটাকে। বনবন করে কয়েকটা পোকা ঘুরছে ওটার চারধারে।
গেটের দিকে কিছুদূর সরে এল রানা দেয়াল ঘেঁষে। এখান থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সামনের বনেটটা হাঁ করা অবস্থায় ফোক্সভাগেনটা দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি বারান্দায়। রানার সামনে বেশ খানিকটা জায়গা ফাঁকা। চাঁদের আলো বিছিয়ে পড়েছে মাঠের উপর। এই মুহূর্তে দ্বাদশীর চাঁদটাকে বড় বেশি উজ্জ্বল মনে হলো। তার।
দ্রুত পদক্ষেপে একটা নিচু গাছের তলায় চলে এল রানা। সেখান থেকে বাড়ির পিছনটা আর মাত্র গজ দশেক দূরে। পিছন দিকে ব্যারাকের মত কয়েকটা সার্ভেন্টস কোয়ার্টার। কোনও লোকজনের চিহ্ন দেখা গেল না ওদিকে। বাতি জ্বলছে না একটাও। কেবল একটা ইলেকট্রিক জেনারেটরের মৃদু গুঞ্জন ধ্বনি আসছে সেদিক থেকে। নাহ্, কেউ লক্ষ করেনি ওকে।
মাথার উপর দিয়ে একটা বাদুড় ডানা ঝটপট করে উড়ে গেল রানাকে সচকিত করে দিয়ে। আপন মনে ঝুলছিল গাছের ডালে, হঠাৎ কী মনে করে সশব্দে ডানা ঝাঁপটে চাঁদের আলোয় উড়তে লাগল ঘুরে ঘুরে।
বাড়ির পিছন দিকে মাটি থেকে একটা মাধবী লতার ঝড় উঠেছে দোতলার ব্যালকনিতে। ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে ঝাড়টা। আর তারই মিষ্টি মধুর গন্ধ আসছে। মৃদু বাতাসে। রানা জানে, এ-সময়ে গাছে কিলবিল, করবে অসংখ্য শুয়োপোকা।
গাড়ি-বারান্দার সামনে সদর দরজা ছাড়া একতলায় ঢোকার আর কোনও উপায় দেখতে পেল না রানা। জানালা দিয়েও কিছু দেখার উপায় নেই। কাঁচের সাসরি ওপাশে ভারী পর্দা ঝোলানো।
আবার কয়েক লাফে এগিয়ে এসে বাড়িটার গায়ে সেঁটে দাঁড়াল রানা। সতর্কভাবে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে জুতোজোড়া খুলে ফেলল। তারপর পিস্তলটা হোলস্টারের মধ্যে রেখে তরতর করে দোতলার ব্যালকনিতে উঠে এল একটা পাইপ বেয়ে। রুমালের ভিতর ডান হাতের পোড়া তালুটা জ্বালা করে উঠল চাপ লেগে।
খোলা দরজা দিয়ে ঢুকতেই প্রথমে পড়ল সাজানো গোছানো সৌখিন একটা শোবার ঘর। পরিপাটি বিছানার উপর দামি বেড কাভার পাতা। পেন্সিল টর্চ জ্বেলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খালি ঘরটা দেখল রানা। বোধহয় বেশ কিছুদিন হলো কেউ ব্যবহার করেনি এ ঘর। পাতলা এক পরত ধুলো জমেছে সব আসবাবপত্রের উপর।
পরপর কয়েকটা ঘর পেরিয়ে একটা বারান্দায় এসে দাঁড়াল রানা। ভূতুড়ে বাড়ির মত শূন্য দোতলায় একটা লোকও নেই। সিঁড়ি ঘরের কাছে আসতেই দেয়ালের গায়ে একফালি আলো দেখা গেল। একতলার ভেন্টিলেটার থেকে আসছে আলোটা।
পায়ের পাতার উপর ভর করে নিঃশব্দে কয়েক ধাপ-নেমে এল রানা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে। ভেন্টিলেটারের ফাঁকে চোখ রেখে দেখতে পেল ড্রইংরুমে একটা সোফায় বসে রানার দিকে মুখ করে কথা বলছে সুলতা, আর রানার দিকে পিছন ফিরে বসা দুজন লোক অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে শুনছে। সুলতা আর লোকগুলোর মাঝখানে একটা টেবিলের উপর সব কটা প্যাকেট রাখা। বড়গুলোর থেকে একটা প্যাকেট আর ছোট প্যাকেটটা খুলে সাজানো আছে টেবিলের উপর ভিতরের জিনিস।
চৌকোণ ধাতব বস্তুটার উপর চোখ পড়তেই রানার সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল। ডিনামাইট! টিএনটি! তা হলে তিনটে বাক্সের মধ্যে করে তিনটে ডিনামাইট এল ভারত থেকে গোপন পথে। সঙ্গের ছোট বাক্সটায় এল একটা রেডিয়ো ট্রান্সমিটার। খুব সম্ভব ডিনামাইটগুলো ফাটানো হবে রেডিয়োর সাহায্যে।
সমস্ত ইচ্ছাশক্তি একত্রিভূত করে কান পেতে রানা শুনতে চেষ্টা করল সুলতার কথাগুলো। কিন্তু নিচু গলায় কথা হচ্ছে বলে কিছুই শোনা গেল না।
সামনে একজন কিছু জিজ্ঞেস করল। সুলতা ট্রান্সমিটারের কয়েকটা ডায়াল ঘুরিয়ে বুঝিয়ে দিল। রানা বুঝতে পারল বিশেষভাবে তৈরি এই রেডিয়ো অপারেটেড ডিনামাইটের ব্যবহার পদ্ধতি বুঝিয়ে দিচ্ছে সুলতা। এ সম্বন্ধে কয়েকদিন বিশেষ ট্রেনিং দেয়ার পর ওকে পাঠানো হয়েছে কলকাতা থেকে। কিন্তু এই শক্তিশালী ডিনামাইট দিয়ে কী ধ্বংস করতে চায় এরা? রাহাত খানের কথা মনে পড়ল, ‘বিরাট কোনও পরিকল্পনার প্রায় সমাপ্তির দিকে চলে এসেছে এরা। …জানতে হবে তোমার কী আছে ‘প্যাকেটে, কাকে দেয়া হচ্ছে সেটা, আর কেন দেয়া হচ্ছে। ওদের সমস্ত কুমতলব বানচাল করে দিতে হবে। কঠিন সংকল্পের মৃদুহাসি ফুটে উঠল রানার ঠোঁটে।