দোতলায় এসে ম্যানেজারের কাউন্টারে থামল ও। চাবিটা দিয়ে বলল, একটু বাইরে যাচ্ছি। আমাদের কোনও চিঠি বা টেলিগ্রাম এলে হাসান আলীর হাতে দিয়ে দেবেন।
‘জী, আচ্ছা।’
‘ফিরতে আমাদের রাত হতে পারে। গেট ক’টা পর্যন্ত খোলা রাখেন আপনারা?
‘গেটে তালা লাগিয়ে দেয়া হয় এগারোটায়। তবে এপাশ দিয়ে একটা পথ আছে। দেরি হলে…’
‘বেশ, বেশ। উৎসাহিত হয়ে রানা বলল, কাউকে দিয়ে একটু চিনিয়ে দিন। পথটা-রাতে দরকার হতে পারে।
‘নিশ্চয়ই, এই সামাদ, যাও তো বাবুকে কিচেনের পাশের রাস্তাটা দেখিয়ে দাও।’
নীচে নেমে সরু একটা গলি দিয়ে মেইন গেটের গজ পনেরো বাঁ দিকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল রানা। দেখল সুলতা ততক্ষণে গাড়িটা ঘুরিয়ে স্টেশনের দিকে রওনা হয়েছে।
হোটেলের সামনে রাস্তার অপর পারে নীল রঙের একটা ওপেল রেকর্ড। দাঁড়িয়ে আছে। তিন লাফে রাস্তা পার হয়ে গাড়িতে উঠে বসল রানা। প্রায় একশো গজ দূরে ফোক্সভাগেনের টেইল লাইট দুটো দ্রুত সরে যাচ্ছে। রানার রিস্ট ওয়াচে তখন বাজে পৌনে ন’টা। রাস্তার ঝলমলে আলোর পাশে শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদটাকে বড় ম্লান দেখাচ্ছে।
এ রাস্তা ও রাস্তা ঘুরে মাইল তিনেক চলবার পর এল নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটি। হাসপাতালের উল্টোদিকে আবগারী শুল্ক দফতরের পাশ দিয়ে গেছে। বায়েজিদ বোস্তামী বা ক্যান্টনমেন্ট রোড। প্রায় নির্জন রাস্তাটা দোহাজারী রেল লাইনটা পার হয়ে, মাজারের পাশ দিয়ে চলে গেছে। ঠেকেছে গিয়ে চিটাগাং ক্যান্টনমেন্টে। বাঁ দিকে একটা রাস্তা গিয়ে মিশেছে রাঙামাটি রোডে।
অতদূর যেতে হলো না, রেল ক্রসিং আর মাজারের মাঝামাঝি জায়গায় এসে। হঠাৎ ডানধারের একটা খোয়া ঢালা কাঁচা রাস্তায় নেমে গেল সামনের ফোক্সভাগেন। বড় রাস্তার পাশে একটা একতলা বাড়ির উঁচু পাঁচিল-ঠিক তারপরই ডান দিক দিয়ে চলে গেছে কাঁচা রাস্তাটা।
ওপেলের নাকটা পাঁচিলের আড়াল থেকে একটু বেরোতেই ব্রেক করল মাসুদ রানা। প্রায় দেড় শ গজ দূরে হাতের বাম ধারে একটা দোতলা বাড়ির লোহার গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল ফোক্সভাগেনটা। তারপর আপনাআপনি বন্ধ হয়ে। গেল গেট। গাড়িটা ব্যাক করে পাচিলের আড়ালে ঘুরিয়ে রেখে নেমে এল মাসুদ রানা।
দুর থেকে দেখা গেল উঁচু প্রাচীর দিয়ে বাড়িটা ঘেরা। একতলার কয়েকটা ঘরে বাতি জ্বলছে, কিন্তু দোতলাটা সম্পূর্ণ অন্ধকার। চাঁদের আলোয় আবছা। কতগুলো উঁচু টিলা দেখা গেল খানিকটা দূরে। একটা নিচু জমি আছে বাড়িটাতে পৌঁছবার আগে হাতের বাঁ ধারে। বোধহয় সেখানে বাড়ি তোলা হবে। মাটি ফেলে অর্ধেকটা ভরাট করা হয়েছে। কয়েক হাজার এক নম্বর ইট জায়গায় জায়গায় থাক দিয়ে সাজিয়ে রাখা।
বাড়িটার গেটের সামনে ডোম বাতির উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত। তাই বা দিকের মাঠের মধ্যে নেমে গেল রানা। ইটের পাঁজার আড়ালে আড়ালে উঁচু প্রাচীরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল ও। দেখল পাঁচিলের উপর আবার তিন ফুট উঁচু কাঁটাতারের বেড়া। রানা বুঝল অত্যন্ত সুরক্ষিত বাড়ি। একবার ভিতরে ঢুকে কোনওভাবে ধরা পড়লে ওখান থেকে আর বেরোতে হবে না। এমন জায়গায়। একটা বাড়িকে এত সুরক্ষিত করার কী উদ্দেশ্য ঠিক বোঝা গেল না।
প্রাচীর বরাবর কিছুদূর বাঁ দিকে চলে গেল রানা। নটা সোয়া নটাতেই এই এলাকা একেবারে নির্জন হয়ে গেছে। একটানা ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে থেকে থেকে নিচু জলা জায়গা থেকে বেসুরো ব্যাঙের ডাক। এক আধটা জোনাকী মিটমিট করছে ম্লান ভাবে।
গোটা কতক দশ ইঞ্চি ইট একটার উপর আরেকটা রেখে তার উপর উঠে দাঁড়াল রানা। আর হাতখানেক উপরে পাচিলের মাথা। লাফিয়ে উঠে পাঁচিল ধরল ও। কাঁটাতারের বেড়াটা প্রায় দেয়ালের গায়ে লাগানো। ওটাকে ঠেলে উঁচু করবার জন্যে যেই ধরেছে, অমনি ছিটকে দশ ফুট দেয়াল থেকে মাটিতে পড়ল রানা। অসম্ভব জোর এক ধাক্কায় মুহূর্তে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল ও। হাজার ভোল্টের ইলেকট্রিসিটি চলছে তারের মধ্য দিয়ে। সেই বিদ্যুত্বাহী তারটা রানার ডান। হাতের তালুতে আড়াআড়িভাবে বসে যাওয়ায় মাংস পোড়া গন্ধ ছুটল। ফোস্কা। পড়ল না। দগদগে ঘায়ের মত কাঁচা মাংস দেখা যাচ্ছে। সাদা রস গড়িয়ে পড়ছে তার থেকে। অজ্ঞান হয়ে নিজের শরীরের ভারে মাটিতে পড়ে না গেলে কয়েক সেকেণ্ডেই মৃত্যু হত রানার।
দু’তিন মিনিট পর ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে এল রানার। কানের কাছে তানপুরার মত একটানা ঝিঁঝি পোকার সুর আর কোলাব্যাঙের ক্ল্যাসিকাল তান শুনে অবাক হলো ও। হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস লাগছে চোখে মুখে। ভাবল, এয়ারকুলারটা বন্ধ করে দিই। ধীরে চোখ মেলল ও। পরিষ্কার চাঁদের আলোয় দেখল একটা দেয়ালের গায়ে কয়েকটা মরচে ধরা শিক দেখা যাচ্ছে। মাটিতে ঘাসের উপর শুয়ে আছে ও। ভাবল, এ কোথায় আছি! হঠাৎ ডান হাতের তালুতে অসম্ভব জ্বালা করে উঠতেই সব কথা মনে পড়ে গেল ওর। উঠে বসে ক্ষত জায়গাটা একবার দেখল রানা। তারপর দেয়ালের উপরের তারগুলোর দিকে। চাইল আবার। ভাবল, আগেই আন্দাজ করা উচিত ছিল আমার। যাক, গতস্য শোচনা নাস্তি। পকেট থেকে রুমাল বের করে ডান হাতটা পেঁচিয়ে নিয়ে। শিকগুলোর দিকে ফিরল ও।
বাড়ির ভিতর থেকে একটা বড় নর্দমা এসে শেষ হয়েছে দেয়ালের বাইরে। ভিতর থেকে পানি এসে এই নিচু জমিতে পড়ে। মোটা শিক দিয়ে বেড়া দেয়া আছে নর্দমাটা। বহুদিনের পুরনো লোহা মরচে ধরে খেয়ে গেছে। সেই নর্দমা দিয়ে হু হু করে দখিনা বাতাস এসে রানার চোখে মুখে লাগছিল এতক্ষণ।