অল্পবয়সী ম্যানেজার ওদের দেখেই এগিয়ে এল।
‘এখানে আর আপনাদের দাঁড়াতে হবে না, স্যর। এই যে নিন আপনাদের ঘরের চাবি-পাঁচতলার দশ নম্বর রুম। আমি এন্ট্রি-বইটা পাঠিয়ে দেব ওপরে, সই করে দেবেন।’
‘ধন্যবাদ। আমাদের ঘরের ওয়েটার কে?
হাসান আলী। ওকে দিয়েই বইটা পাঠাচ্ছি, স্যর।
পাঁচতলায় উঠে এল, ওরা। দেখল সুটকেস দুটো নিয়ে ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে পোটার।
ঘরে ঢুকে প্রথমেই রানা এয়ারকুলারের হাই কুল লেখা সাদা বোতামটা টিপে দিল। মালগুলো ঘরে এনে রাখতেই পাঁচ টাকার একটা নোট বখশিশ দিয়ে দিল। পোর্টারকে। আশাতিরিক্ত বখশিশ পেয়ে সালাম ঠুকে বেরিয়ে গেল সে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একজন ঝাড়দারের সঙ্গে একহাতে একটা বই আর অন্য হাতে কিছু পরিষ্কার বিছানার চাদর ও বালিশের ওয়াড় নিয়ে ঘরে ঢুকল হাসান আলী।
একটা আইসিআই ফ্লিট প্রে-গান দিয়ে সারা ঘরে, বিশেষ করে বিছানার তলে, টেবিলের নীচে আর আলমারির পিছনে, স্প্রে করল জমাদার, তারপর ভিম এর কৌটো নিয়ে অ্যাটাচড বাথরুমে ঢুকল কমোড, বাথটাব আর বেসিনটা পরিষ্কার করবার জন্য। হাসান আলী নিপুণ হাতে পুরনো বেড শিট আর বালিশের ওয়াড় সরিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে দিল ঘরটাকে দুই মিনিটের মধ্যে। এই কাজগুলো এরা সবসময় নতুন কাস্টোমারের সামনে করে-আগে থেকে করে রাখলে অনেক সময় আবার ডবল করে করতে হয়, তাই।
সুলতা বলল, একটু জল খাওয়াতে পারো? ঠাণ্ডা?’
‘এক্ষুণি নিয়ে আসছি।’ হাসান আলী ছুটল পানি আনতে।
বড়সড় ঘরটায় পাশাপাশি দুটো সিঙ্গেল খাট-ইচ্ছে করলে জোড়া দিয়ে নেয়া যায়। কোণে একটা সাধারণ চম্বল কাঠের আলমারি। একটা মাঝারি গোছের ডাইনিং টেবিলের দু’পাশে দুটো চেয়ার রাখা। একটা ড্রেসিং টেবিল আর একটা ইজি চেয়ার। এই হচ্ছে ঘরের আসবাব।
রানাকে রিস্ট ওয়াচটা খুলে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখতে দেখে সুটকেস থেকে কিছু কাপড় বের করতে করতে সুলতা বলল, আমি কিন্তু আগে যাচ্ছি। বাথরুমে। সারাদিনের এই ধকলের পর এক্ষুণি চান করতে না পারলে মরে যাব।’
‘মেয়েমানুষ, একবার বাথরুমে ঢুকলে তো আর বেরোতে চাইবে না সহজে। একটু থেমে আবার বলল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে, তুমিই আগে যাও–আমি পরে যাব। অলওয়েজ লেডিজ ফাস্ট।
হাসান আলী দু’হাতে দু’বোতল ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি নিয়ে ঢুকল। দুটো গ্লাস দিয়ে বোতলগুলোর মুখ ঢাকা। দশ টাকা বখশিশ পেয়ে সব ক’টা দাঁত বেরিয়ে গেল হাসান আলীর।
‘কিছু খাবে, সুলতা?’ রানা প্রশ্ন করে।
‘কেক-বিস্কিট গোছের কিছু আনতে বল। আমি এক্ষুণি গা-টা ধুয়ে আসছি। এক গ্লাস পানি খেয়ে বাথরুমে গিয়ে ঢুকল সুলতা।
কয়েকটা কেক পেস্ট্রি আর দু’কাপ কফি আনতে বলল রানা। হাসান আলী চলে যাচ্ছিল, আবার ডাকল রানা। আরও একটা দশ টাকার নোট ওর হাতে গুঁজে দিয়ে নিচু গলায় বলল, তোমার একটা কাজ করতে হবে হাসান আলী, পারবে? টাকাটা রেখে দাও, বখশিশ।
বিস্মিত হাসান আলী চট করে হাতটা উঠিয়ে সালাম করল দ্বিতীয় বার।
‘খুব পারব, স্যর।’ বিগলিত হাসান আলী এখন পা-ও চাটতে পারবে।
ইঙ্গিতে ওকে কাছে সরে আসতে বলে চাপা গলায় বলল রানা, ‘গত রাতে হঠাৎ ওর (চোখদুটো তেরছা করে বাথরুমের দিকে দেখাল রানা) বাবা মারা গেছেন খবর এসেছে। বাবার একমাত্র মেয়ে ও। খুব আদরের মেয়ে। খবরটা। ওকে জানানো হয়নি এখনও, বুঝলে? (মাথা ঝাঁকাল হাসান আলী) এখন খবরটা ওকে হঠাৎ করে জানাতে চাই না, ওর শরীর অত্যন্ত দুর্বল, আচমকা আঘাত পেলে কী হয়ে যায় বলা যায় না। তাই না? (যেন খুব ব্যথা পেয়েছে, এমন মুখ করে সায় দিল হাসান আলী) সেজন্যে তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। আমার কিম্বা ওর কোনও চিঠি বা টেলিগ্রাম এলে ম্যানেজারের কাছ থেকে তুমি নিয়ে নেবে। সেটা নিয়ে গোপনে আমার হাতে দেবে, যেন ও ঘুণাক্ষরেও টের না পায়। জিজ্ঞেস করলে বলবে কোনও চিঠি বা টেলিগ্রাম আসেনি। আর কেউ যদি ওর কাছে টেলিফোন করে বা দেখা করতে চায়, ও থাকুক বা না-ই থাকুক সোজা বলে দেবে সাহেবের সঙ্গে বাইরে গেছে। কী, পারবে না?’
‘ঠিক আছে, স্যর, কোনও চিঠিপত্র-টেলিফোন বা লোক এলে আমি সামলে নেব। কিন্তু উনি যদি কাউকে টেলিফোন করেন তখন?
সে দিকটা আমি দেখব, তুমি কেবল এটুকু করলেই হবে। এখন যাও তো, চট করে কিছু খাবার নিয়ে এসো।
একটা সিনিয়র সার্ভিস ধরিয়ে ঠাণ্ডা ঘরটায় ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করল রানা। সারাদিনের একটানা পরিশ্রমের পর এতক্ষণে চোখ দুটো একটু বিশ্রাম পেল। চোখের পাপড়িতে অল্প অল্প জ্বালা অনুভব করল ও। শুধু শুধুই পুড়তে থাকল সিগারেটটা। পুড়তে পুড়তে ছোট হয়ে যখন আঙুলে আঁচ লাগল তখন চোখ মেলে দেখল উগ্র লাল রঙের একখানা খাটাউ প্রিন্ট শাড়ি সাদাসিধে একহারা করে গায়ে জড়িয়ে বাথরুম থেকে বেরোচ্ছে সুলতা। বক্ষাবরণ পরেনি। তাই উন্নত স্তন যুগল আর শাসন মানছে না। প্রতি পদক্ষেপে দুলে উঠে দোলাচ্ছে একমাত্র দর্শকের মন।
৪
সুলতা লিফটে উঠতেই মাসুদ রানা ঘরে তালা দিয়ে তর তর করে নেমে এল সিঁড়ি বেয়ে। রানা ভাবছিল, লিফটের ঠিক পাশেই ‘সিঁড়ি ঘর, একই করিডোর দিয়ে বেরোতে হয়, ওখান দিয়ে সুলতার পিছন পিছন বেরোলে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি।