স্বাগতম। চিটাগাং জেলার শুরু
হাতের বাঁ ধারে অল্প কিছু দূর দিয়ে লম্বালম্বিভাবে মাটির টিলা সেই যে আরম্ভ হয়েছে, আর শেষ হতে চাইছে না কিছুতে। প্রায়ই ছোট ছোট বাজার, গঞ্জ পড়তে লাগল পথে। কাজেই গতি অনেক কমে গেল গাড়ির। সবচাইতে অসুবিধা করল বাঁশ বোঝাই গরু বা মোষের গাড়িগুলো। রাস্তার ঠিক মাঝখান দিয়ে চলে ওগুলো। দূর থেকে হর্ন বাজালে নড়ে না রাস্তার উপর থেকে। যখন কাছে যাওয়া যায় তখন হঠাৎ করে গাড়ি ঘুরিয়ে বাম ধারের অসমতল কাঁচা রাস্তার উপর নেমে পড়ে। ফলে পিছনের লম্বা বাশগুলো রাস্তার উপর আড়াআড়িভাবে চলে এসে সমস্ত পথ বন্ধ করে দেয়। কাঁচা রাস্তায় গরুর গাড়িগুলো আবার পাকা রাস্তার সঙ্গে সমান্তরাল না হওয়া পর্যন্ত অচল অবস্থায় ড্রাইভিং সিটে বসে মনে মনে এদের গুষ্টি উদ্ধার করা ছাড়া উপায় নেই।
কই, আপনি যে কিছুই বলছেন না! আমিই কেবল বক বক করে যাচ্ছি।’ নিজের কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে জিজ্ঞেস করল সুলতা।
‘আমি অত সুন্দর করে বলতে পারি না।’ এড়িয়ে যাবার জন্য বলল রানা।
সজোরে হেসে কথাটা উড়িয়ে দিল সুলতা। একটা মাইল-পোস্ট পার হয়ে যাচ্ছিল, চট করে দেখে নিয়ে বলল, ‘চিটাগাং টেন মাইলস।
তখন গোধূলি লগ্ন। সারাদিন পৃথিবীর উপর অগ্নিবর্ষণ করে সূর্যটা বঙ্গোপসাগরে ডুব দিয়ে গাটা জুড়োচ্ছে এখন। পশ্চিম দিগন্তে এক-আধ ফালি সাদা মেঘ এখন অনুরাগে লাল। তারই হাল্কা আলো এসে পড়েছে সুলতার মুখের উপর। রূপকথার রাজকন্যার মত সুন্দর লাগছে ওকে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইল রানা ওর মুখের দিকে। রাস্তায় পড়ে থাকা একটা ইটের উপর হোঁচট খেল গাড়িটা। ফিক করে হেসে সুলতা বলল, অ্যাকসিডেন্ট করবেন নাকি?
‘যদি করি তবে দোষ তোমার, উত্তর দিল রানা।
পিচ্ছিল কাতান শাড়িটা এলোমেলো হাওয়ায় কাঁধ থেকে খসে পড়েছিল কখন কোলের উপর। পাতলা সাদা ব্লাউজটা ঘামে ভিজে সেঁটে রয়েছে গায়ের সঙ্গে। ভেজা কাপড়ের মধ্য দিয়ে বক্ষ বন্ধনীর সেলাইয়ের কাজগুলো পর্যন্ত পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সচকিত হয়ে বুকের কাপড়টা তুলে দিয়ে মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল সুলতা,
কী দেখছেন? রানার মনের পর্দায় যে রঙ ধরেছে তা দৃষ্টি এড়ায়নি ওর।
‘তোমাকে বড় সুন্দর লাগছে।’ যেন এটা একটা সাধারণ কথা, যেন এতে কারও কিছু যায় আসে না, এমনিভাবে বলতে চেষ্টা করল রানা। কিন্তু ওর কণ্ঠস্বর প্রতারণা করল ওর সঙ্গে। এমন মধুর লগ্নে এই সাধারণ কথা অদ্ভুত ব্যঞ্জনা পেয়ে শোনাল ঠিক প্রথম প্রেমের প্রথম আত্মনিবেদনের মত। এই একটি কথায় দুটি মন হঠাৎ রঙীন হয়ে উঠে সমস্ত ভুবন রাঙিয়ে নিতে চাইল আপন মনের আবীরে।
নিজের কণ্ঠস্বর শুনে নিজেই চমকে উঠল মাসুদ রানা। একী বলল ও? কেন এই বোকামি করতে গেল? তাকে কি এই জন্য পাঠানো হয়েছে পিসিআই থেকে?
রানার মুখ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে আসা কথাটা থমকে দিয়েছিল সুলতাকে। কথাটা নিয়ে নিজের মনেই নাড়াচাড়া করল সে কয়েক মুহূর্ত। এত ভাল লাগল। কেন কথাটা?
‘আপনি–
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সুলতা, ওকে থামিয়ে দিয়ে রানা বলল, আর ‘আপনি’ নয়, এবার ‘তুমি’। চিটাগাং আর সাত মাইল। এখন থেকে আমি তোমার স্বামী, তুমি আমার বিবাহিতা স্ত্রী, বুঝলে?
আমি তো নকল স্ত্রী, তোমার আসল স্ত্রী জানতে পারলে মারবে তোমাকে। তাই না?
‘বিয়েই হয়নি, তার আবার আসল স্ত্রী!
‘ওমা, এত বয়স হয়েছে বিয়ে করনি কেন? কাউকে ভালবাস বুঝি?
নাহ্। ওসব বালাই নেই।
‘সাময়িক প্রেম?
‘প্রচুর। বাবা-মা নেই বুঝি তোমার? নাহ।’
‘আমারও নেই। থাকলে এভাবে বখে যেতে পারতাম না।’
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল সুলতা। আবার খসে পড়া আঁচলটা তুলে দিল বাঁ কাঁধে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে-ফোক্সভাগেনের টিমটিমে হেড লাইট জ্বেলে দিল রানা।
প্রায় দু’বছর পর চিটাগাং-এ এসে বেশ আশ্চর্য লাগল রানার। শহরের ভোলটাই যেন পাল্টে গেছে। উন্নয়নের কাজটা যেন ঢাকার চাইতেও অনেক বেশি। দ্রুত হয়েছে এখানে। হরেক রকম অট্টালিকা, ঝলমলে দোকান-পাট। রাস্তায় সারিসারি ফ্লোরেসেন্ট বাতি দিন করে রেখেছে রাতকে। পথঘাট বেশ পরিষ্কার মনে ছিল রানার, কাজেই স্টেশন রোডের মিসখা হোটেল চিনে বের করতে অসুবিধা হলো না কিছুই।
হোটেলের সামনে ফুটপাথের ধারে এমন বেকায়দা করে গাড়ি রাখল রানা যাতে খুব পাকা ড্রাইভারেরও কমপক্ষে দুই মিনিট সময় লাগে ওটাকে বাগে এনে রাস্তায় চালু করতে।
গাড়ি থামতেই হোটেলের পোর্টার দৌড়ে এল। সুলতা গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল ফুটপাথে। ওর সিটটা ভাঁজ করে ইঙ্গিত করতেই পিছনের সিটে রাখা রানা এবং সুলতার সুটকেস দুটো বের করল পোর্টার। গাড়ির কাঁচ তুলে দিয়ে দরজাটা লক করে চাবিটা দিল রানা সুলতার হাতে।
নীচতলার গেট দিয়ে ঢুকেই করিডোরের বাঁ ধারে লিফট। বুড়ো লিফটম্যানের থুতনি থেকে ঝুলছে অল্প একটু পাকা ছাগলা দাড়ি। সালাম করল সে রানাকে দেখে। পোর্টারকে পাঁচতলার দশ নম্বর রুমে মাল নিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়ে লিফটে উঠল রানা ও সুলতা।
দোতলায় ম্যানেজারের কাউন্টার। সামনে মস্ত বড় লাউঞ্জে ফাঁক ফাঁক করে রাখা টেবিলগুলোর উপর প্লেট, কাঁটা, চামচ, ছুরি ইত্যাদি ডিনারের সরঞ্জাম পরিপাটি করে সাজানো। গ্লাসের মধ্যে সদ্য লণ্ডি থেকে ধোয়া ইস্তিরি করা ন্যাপকিন ফুলের তোড়ার মত কায়দা করে রাখা। কোনও কোনও টেবিল ঘিরে দু’জন চারজন লোক বসা। বেশির ভাগই খালি।