ক্যাপ্টেন মোহন রাও ড্রাইভিং সিটে উঠে বসে হাতের ইশারায় কাছে ডাকল রানাকে। রানা কাছে যেতেই নিচু গলায় মেয়েটিকে ইঙ্গিত করে অশ্লীল একটা রসিকতা করল সে; তারপর বলল, ‘যান মশাই, প্রাণ ভরে মৌজ করুন গিয়ে।
এই রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে এসব নোংরা রসিকতা শুনে পিত্তি জ্বলে গেল রানার। ঠাই করে এক চড় বসিয়ে দিতে ইচ্ছে করল ব্যাটার ফোলা গালের উপর। তবু চেষ্টাকৃত দেতো হাসি হাসল একটু।
হঠাৎ পিছন থেকে খটাশ করে জোরে একটা আওয়াজ হতেই চমকে ফিরে দাঁড়াল রানা। দেখল তিনজন একসঙ্গে বুট ঠুকে স্যালিয়ুট করছে ওকে। রানার। ডান হাতটা দ্রুত চলে এসেছিল পিস্তলের কাছে–এক সেকেণ্ডে সামলে নিয়ে ও-ও হাত তুলে ভারতীয় কায়দায় প্রত্যাভিবাদন করল। পরমুহূর্তেই এক লাফে জিপের পিছনে উঠে বসল তিন সেপাই তিনটে বানরের মত, এবং সঙ্গে সঙ্গে সাঁ করে চলে গেল জিপটা যেদিকে যাচ্ছিল সেদিকেই।
বিলীয়মান গাড়িটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল রানা। দিনে দুপুরে ভোজবাজীর মতই ঘটে গেল যেন ঘটনাগুলো। এই কয়মিনিট আগে গ্রীষ্মের প্রখর রোদের মধ্যে উত্তপ্ত রাস্তার উপর সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে একা গাড়ি চালাচ্ছিল ও। হঠাৎ কোথাকার এক জিপ এসে তার সমস্ত উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নিরসন করে অজানা অচেনা এক সুন্দরী মেয়েকে তুলে দিয়ে গেল তার হাতে, যেন জাদুমন্ত্রের বলে। এখন আর সে জিপের কোনও চিহ্নও নেই-রয়েছে কেরল ও, আর মেয়েটি।
‘হাঁ করে কী দেখছেন, সুবীর বাবু! এদিকে গরমে যে ঘেমে নেয়ে উঠলাম। জড়তাহীন পরিষ্কার সুরেলা গলা।
গাড়িতে ঢুকেই একটা সুগন্ধ পেল রানা। শ্যানেল নাম্বার ফাইভ সেন্টের মিষ্টি গন্ধে ভরপুর হয়ে আছে গাড়ির ভিতরটা।
‘সিগারেট খেলে অসুবিধে হবে আপনার?
‘মোটেও না। বরং সিগারেট না খেলেই ব্যাটাছেলেকে মেয়েমানুষের মত লাগে। গাড়িতে তাদের পাশে বসতে ইচ্ছে করে না।
‘যাক বাঁচা গেল। বলে রানা একটা সিনিয়র সার্ভিস ধরাল। গাড়ি তখন। ছুটছে পঁচাত্তর মাইল বেগে। লম্বা এক টান দিয়ে নাক-মুখ দিয়ে প্রচুর ধোয়া বের। করল রানা। তারপর আগের কথার খেই ধরে বলল, ‘বিয়ের আগে প্রায় সব মেয়েই এরকম বলে। কিন্তু বিয়ে হয়ে গেলেই তাদের মতামত পাল্টে যায়। স্বামীর নেশা ছাড়াবার জন্যে তখন উঠে পড়ে লেগে যায় তারা।
মেয়েটা মাথা ঝাঁকিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, বাধা দিয়ে রানা বলল, ‘দেখুন তো কাণ্ড, আপনার নামটাই জিজ্ঞেস করা হয়নি এখনও।
‘সুলতা রায়।
‘ক’বছর আছেন সার্ভিসে?
‘দেড় বছর। এতদিন ফাইল নিয়ে ঘাটাঘাটি করেছি। এই প্রথম আমার বাইরে আসা। কপালটা ভাল, প্রথমেই আপনার সঙ্গে কাজ করবার সুযোগ পেয়ে, গেলাম।’
কপাল ভাল, তারমানে? মনে মনে হাসল রানা। কপালটা তোমার খারাপ, সুন্দরী।
‘ভাল বলব না? সুবীর সেনের সঙ্গে কাজ করবার সুযোগ কজনের হয়? সার্ভিসের অন্যান্য মেয়েরা তো হিংসায় মরে যাচ্ছে।
‘আচ্ছা? এতই বিখ্যাত লোক, আমি? মৃদু হাসল রানা।
কথায় কথায় মেয়েটি বলল কেমন ভাবে তার সাধারণ ডিউটি থেকে তাকে সরিয়ে সাতদিন স্পেশাল ট্রেনিং দেয়া হয়েছে, তারপর কলকাতা থেকে বর্ডারে আনা হয়েছে, হেলিকপ্টারে করে। সেখান থেকে কত বন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে বর্ডার ক্রস করেছে জিপটা ভয়ে ভয়ে, এখন অন্য পথে ফিরে যাবে। আবার সেটা ভারতীয় এলাকায়।
ফেনীতে এসে সুলতা বলল তেষ্টা পেয়েছে। দুজন দুটো ডাবের পানি খেয়ে নিয়ে আবার রওনা হলো। এরই মধ্যে আরও সহজ ও সাবলীল হয়ে এসেছে। সুলতা রায়। মাসুদ রানা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে করে ওর অতীতের কথা, বাবা-মার কথা, ছেলেবেলার কথা শুনল মন দিয়ে। সুলতাও মনোযোগী শ্রোতা পেয়ে যারপরনাই উৎসাহিত হয়ে ওর নিজস্ব প্রাঞ্জল ভাষায় বলে গেল অনেক কথা। পথের ক্লান্তি ভুলে গেল দুজন।
বাবা ছিলেন উকিল-ছেলেবেলায় লাক্ষৌ শহরে মানুষ, ক্যালকাটা লেডি ব্রাবোর্ন থেকে গ্রাজুয়েশন, প্রেমে ব্যর্থতা-তারপর দু’একটা পদস্থলন-শেষে সিক্রেট সার্ভিসে ঢুকে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আরও স্থলন।
মেয়েটার মস্ত বড় গুণ হচ্ছে দু’চার মিনিটে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিতে পারে। নিজের কোন কথাই চেপে রাখবার চেষ্টা করল না ও। ওর জীবনের সবচাইতে গোপন কথাটাও সে বলল রানাকে। কেমন ভাবে অমানুষিক বলপ্রয়োগ করে প্রথমবার ওকে অপবিত্র করেছিল একজন নামকরা ফিল্ম ডাইরেক্টার সেকথা বলতে বলতে টপ টপ করে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল ওর চোখ থেকে। রুমাল দিয়ে মুছে নিয়ে একটু থেমে আবার বলল, ‘কেন যে এসব কথা বলছি জানি না-ভাল করে চিনিও না আপনাকে–কিন্তু বড় ভাল লাগছে নিজের সব কথা। আপনাকে বলতে। মনে হচ্ছে আমার সব কথা আপনি বুঝবেন, আপনার দ্বারা আমার কোনও ক্ষতি হতে পারে না।’
মেয়েটার কথাবার্তার ধরন অনেকটা পুরুষের মত। চালচলনেও কিছুটা পুরুষালী ভাব। মেয়েলীপনা বা ন্যাকামির লেশমাত্র নেই ওর মধ্যে।
একটা ব্রিজের কাছে আসতেই দেখা গেল দুটো বাঁশ পুঁতে একখানা সাইনবোর্ড টাঙানো:
নোয়াখালী জেলার শেষ সীমা।
বেশ বড় ব্রিজ। নীচ দিয়ে নদী গেছে একটা। ফেনী নদী। গ্রীষ্মের তাপে শুকিয়ে ক্ষীণ হয়ে গেছে নদীটা। ব্রিজ পার হতে এক টাকা শুল্ক দিতে হলো। অপর পারে আরেকটা সাইনবোর্ডে লেখা: