হঠাৎ একটা লোহার রড, বোঝাই ট্রাক সামনে থেকে এসে ঘাড়ের উপর উঠবার উপক্রম করল রানার। বেশ কিছুটা দূর থেকেই স্পীড কমিয়ে তিরিশে নিয়ে এসেছিল রানা, কিন্তু ভাবতেও পারেনি যে ট্রাক ড্রাইভারটা হারামীপনা করে সবটা রাস্তা জুড়ে ফুল স্পীডে আসবে–জায়গা ছাড়বে না একটুও। এক হেঁচকা টানে স্টিয়ারিংটা ঘুরিয়ে ঘাসের উপর নেমে এল রানা। ডান পা-টা এক্সিলারেটর ছেড়ে হাইড্রলিক ব্রেকের উপর তিনটে মৃদু চাপ দিল। গাড়িটা ততক্ষণে কয়েকটা ছোট-বড় গর্তে পড়ে পদ্মার ঢেউয়ের মাথায় ডিঙি নৌকার মত নাচানাচি আরম্ভ করেছে। কিছুদূর গিয়ে থেমে গেল গাড়ি। ট্রাক ততক্ষণে বহুদূর চলে গেছে। অসম্ভব রাগ হলো রানার। নির্জন রাস্তায় একা গাড়িতে বসে ট্রাক ড্রাইভারের উদ্দেশে অশ্রাব্য অকথ্য ভাষায় সজোরে গালাগালি করল ও কিছুক্ষণ ইংরেজি বাংলা-উর্দু মিশিয়ে। তারপর সন্তুষ্টচিত্তে আবার স্টার্ট দিল গাড়িতে।
.
চোদ্দগ্রাম ছাড়িয়ে গেল রানা, তবু কারও দেখা নেই।
ঠিক তিনটে সাতচল্লিশে রানা দেখল একটা ওয়্যারলেস ফিট করা উইলিজ জিপ আসছে দূর থেকে। একটু কাছে আসতেই আরোহীদের স্পষ্ট দেখা গেল। কয়েকজন মিলিটারি পোশাক পরা লোক এবং একজন মহিলা বসে আছে। গাড়িতে। এক মুহূর্তে প্রস্তুত হয়ে নিল রানা। টী-শার্টের উপরের দিকের দুটো বোতাম খোলাই ছিল–আরেকটা খুলে দিল ও, যাতে প্রয়োজনের সময় পিস্তল বের করতে কোনও অসুবিধে না হয়। বাম বাহু দিয়ে পাজরের সঙ্গে চেপে স্প্রিং লোডেড হোলস্টারটার স্পর্শ অনুভব করল ও একবার। গজ পনেরো থাকতেই নাম্বার প্লেট দেখে ব্রেক কষল জিপ। ড্রাইভার হাত বের করে রানাকে থামবার ইঙ্গিত করল। রানাও ব্রেক করে ঠিক জিপের পাশে থামাল ফোক্সভাগেন।
রানাকে দেখেই মিষ্টি হেসে মেয়েটি বলল, নমস্কার, সুবীর বাবু।
নমস্কার। সদ্য ফোঁটা শিশির মাখা ফুলের মত প্রাণবন্ত এবং সুন্দরী মেয়েটির দিকে এক মুহূর্ত অবাক চোখে চেয়ে উত্তর দিল রানা।
চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়স হবে মেয়েটির। উন্মুক্ত ক্ষীণ কটি। কপালে কুমকুমের লাল টিপ। ঠোঁটে হাল্কা গোলাপী লিপস্টিক। বড় করে একটা বিড়ে খোঁপা বেঁধেছে মাথায়-তাতে সুন্দর করে প্লাস্টিকের কটা রজনীগন্ধা গোঁজা। সরু চেনের সঙ্গে বড় একটা লাল রুবি বসানো লকেট ঝুলছে বুকের উপর। ডান হাতে এক গাছি সোনার চুড়ি, বাঁ হাতে ছোট্ট একটা রোলগোল্ডের সাইমা ঘড়ি। ফরসা গায়ের রঙ তার আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে স্বাস্থ্যের প্রাচুর্যে। একহারা লম্বা গড়ন অটুট স্বাস্থ্যের লাবণ্যে কমনীয়। এমন আকর্ষণীয় চেহারা সহজে চোখে পড়ে না। আরও উগ্র দেখাচ্ছে ওকে ঝাঝাল লাল আর হলুদে মেশানো কাতান শাড়িটা আঁটসাঁট করে পেঁচিয়ে পরায়। সুগোল, সুপরিপুষ্ট স্তন যুগল সগর্বে আত্মপ্রকাশ করতে চাইছে। সুগঠিত দেহের প্রতিটা নিটোল অঙ্গ, প্রতিটা খাঁজ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে নিপুণ হাতে এঁটে পরা শাড়ির নীচ থেকে। সত্যিই এমন চেহারা সহজে চোখে পড়ে না।
গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে সশব্দে দরজা বন্ধ করল রানা। জিপের ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে এসে হ্যাণ্ডশেক করল আর্মি অফিসার রানার সঙ্গে। বলল, ‘দি। ইজ ক্যাপ্টেন মোহন রাও। হাউড়ু ইয়ু ডু, মি. সেন?
‘হাউ ডু ইয়ু ডু। স্বাভাবিক গাম্ভীর্যের সঙ্গেই উত্তর দিল রানা।
কয় প্যাকেট লাগবে আপনার, মি. সেন? প্রশ্ন করল মোহন রাও।
‘চারটে।
‘বেশ, গাড়ির পেছনের সিটে তুলে দিচ্ছি প্যাকেটগুলো।
না। সামনের বুটে রাখতে বলুন।
ব্যস, আর প্রয়োজন হলো না। এটুকুতেই বুঝে নিল ক্যাপ্টেন যা বুঝবার। জোরে রানার হাতটা আবার বার কয়েক ঝাঁকিয়ে চোখে-মুখে একটা আবছা ইশারা করল সে।
ততক্ষণে মেয়েটি এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। একটু মিষ্টি গন্ধ। মৃদু রিনি-ঠিনি চুড়ির শব্দ। আঁচল উড়ছে বাতাসে।
‘বাব্বা, কী অসম্ভব গরম!’
‘আপনি গাড়িতে গিয়ে বসুন না। যেন কতকালের চেনা, এমনিভাবে বলল রানা। মেয়েটির দ্বারা এই মুহূর্তে কোনও ক্ষতির সম্ভাবনা নেই-লক্ষ্য রাখতে হবে সিপাই তিনজন আর ক্যাপ্টেনটার দিকে।
গাড়িতে গিয়ে বসল মেয়েটা। তারপর বাঁ হাতে লিভারে টান দিয়ে সামনের বনেটটা খুলে দিল। ফোক্সভাগেন গাড়ি সম্বন্ধে মেয়েটির পরিষ্কার ধারণা আছে বোঝা গেল।
হিন্দীতে জিপের লোকগুলোকে কিছু বলল ক্যাপ্টেন। সশব্দে লাফিয়ে নামল গাড়ি থেকে ইপিআর-এর ইউনিফরম পরা তিনজন সৈন্য। বাঙালী বলে মনে হলো না। বোধহয় দাড়ি কামানো শিখ হবে। বিনা বাক্যব্যয়ে জুতোর বাক্সের চাইতে সামান্য বড় তিনটে প্যাকেট খুব যত্নের সঙ্গে এনে পাশাপাশি সাজিয়ে রাখল সেপাইরা বুটের মধ্যে। বাক্সগুলো পাতলা কেরোসিন কাঠের। বাইরে থেকে স্টিলের পাত দিয়ে জড়িয়ে শক্ত করে বাঁধা। দু’একটা খড়কুটো বেরিয়ে আছে। প্যাকেটের গায়ের কোনও ফাঁক দিয়ে। গায়ে লেবেল বা কোনও রকম চিহ্ন নেই। ভিতরে কী আছে ঠিক বুঝতে পারল না রানা, কিন্তু বয়ে আনার ধরন দেখে মনে হলো ছোট হলেও যথেষ্ট ভারী প্যাকেটগুলো। একজন ফিরে গিয়ে আর একটা অপেক্ষাকৃত ছোট প্যাকেট এনে রাখল বুটের ভিতর, তারপর বনেটটা নামিয়ে দিতেই অটোমেটিক লক হয়ে গেল সেটা।
বাকি দুজন ততক্ষণে মেয়েটির একটা সুটকেস তুলে দিয়েছে গাড়ির পিছনের সিটে। এদের মনে কোনও রকম সন্দেহের উদ্রেক হয়নি দেখে আশ্বস্ত হলো রানা। পিসিআই-এর নিপুণ কাজের জন্যে গর্ব অনুভব করল ও।