অন্যত্র পশ্চাদপসরণে ব্যস্ত পাকিস্তানী বাহিনীর লক্ষ্যস্থল ছিল দক্ষিণের দিকে–খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রামের উপকূলবর্তী অঞ্চলে। উপকূল থেকে জাহাজযোগে–এবং কোন ক্ষেত্রে ভিন্ন দেশীয় পতাকা ব্যবহার করে–বাংলাদেশ ছেড়ে পালাবার ব্যাপারে তাদেরকে সচে দেখা যায়। পাকিস্তানী সৈন্যদের অবরুদ্ধ করার পূর্ব নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য এবং অংশত উপকূলভাগে সপ্তম নৌবহরের সংযোগ প্রতিষ্ঠার কাজ অপেক্ষাকৃত দুরূহ করার জন্য ১১ই ডিসেম্বর থেকে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর এবং উপকূলভাগে অবকাঠামো, জাহাজ, নৌযান প্রভৃতির ধ্বংস সাধনে ভারতীয় নৌবাহিনীর বিমান ও যুদ্ধজাহাজ ব্যাপকভাবে নিযুক্ত করা হয়। ঐ দিনই ঢাকার উদ্দেশে ভারতের একটি পদাতিক ব্যাটালিয়ান একটি গোলন্দাজ ইউনিটকে সঙ্গে করে নরসিংদীর দিকে এগুতে থাকে। তবে পূর্ব রাত্রিতে যুদ্ধের গতি বৃদ্ধির জন্য দিল্লীতে যে সিদ্ধান্তই গৃহীত হয়ে থাকুক, বিস্তীর্ণ মেঘনার এই সব অঞ্চলে প্রকৃতির প্রতিবন্ধকতা বড় প্রবল। তদুপরি সর্বত্রই ছিল যানবাহনের তীব্র অভাব, পথঘাট ভাঙ্গা। মন্থর হলেও এই সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে ভারতীয় ইউনিটের অগ্রগতি চলতে থাকে স্থানীয় জনসাধারণের স্বতঃস্ফুর্ত সহযোগিতায়।
প্রয়োজনের তুলনায় ভারতীয় বাহিনীর এই মন্থর’ অগ্রগতিতে সে সময় যারা উদ্বিগ্ন ছিল, সোভিয়েট ইউনিয়ন নিঃসন্দেহে তাদের অন্তর্ভুক্ত। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে তারাই ছিল মার্কিনী চাপের সরাসরি সমুখে। দাঁতাত, SALT I ও প্রভৃতি বিষয়ে তাদের ক্ষতির আশঙ্কা ছিল সব চাইতে বেশী। অন্য অর্থে তাদের সামরিক ঝুঁকিও ছিল বিরাট। বাংলাদেশের উপকূলভাগের দিকে প্রেরিত মার্কিন সপ্তম নৌবহরের বিরুদ্ধে সোভিয়েট নৌশক্তির যে দ্রুত সমাবেশ ঘটানো হয় তার ফলে এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী নৌবহরের মধ্যে যেমন সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটা বিচিত্র ছিল না, তেমনি কোথায় যে তার শেষ হত তা বলা কঠিন ছিল। কাজেই বাংলাদেশ যুদ্ধের দ্রুত পরিসমাপ্তির জন্য এবং এরপর এই যুদ্ধ যাতে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্প্রসারিত না হয়, সম্ভবত তাও নিশ্চিত করার জন্য সোভিয়েট সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কুজনেটসভ দিল্লী অভিমুখে রওনা হন।
উপমহাদেশ থেকে গোলার্ধ পথ দূরে নিউইয়র্কে হুয়াং হুয়ার ‘সর্বশেষ রাইফেল পর্যন্ত লড়াই করার অভিপ্রায় শোনার পরদিন উদ্দীপ্ত কিসিঞ্জার ওয়াশিংটনে ফিরে এসেই সোভিয়েট প্রতিনিধি ভেরেন্টসভকে চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি প্রদান করেন: তার পরদিন অর্থাৎ ১২ই ডিসেম্বর ওয়াশিংটনের মধ্যাহ্নের আগে ভারত যদি যুদ্ধবিরতি ঘোষণা না করে, তবে সমুচিত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে অগ্রসর হবে।
৭-৮ই ডিসেম্বরে সাধারণ পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব বিপুল ভোটাধিক্যে অনুমোদিত হওয়ার পর ৮ই ডিসেম্বর WSAG বৈঠকে পশ্চিম পাকিস্তানকে ধ্বংস করার গোপন ভারতীয় প্রচেষ্টা সম্পর্কে সিআইএ পরিবেশিত তথ্যের ভিত্তিতে ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের যৌক্তিকতা আবিষ্কার করা, ৯ই ডিসেম্বরে সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে যাত্রার নির্দেশ দেওয়া, ১০ই ডিসেম্বরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চাদপসরণ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরেও পাকিস্তানী শাসকদের মত পরিবর্তনে বাধ্য করা এবং ভারত অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ঘোষণায় সম্মত না হলে ১৯৬২ সালের স্মারকলিপি অনুযায়ী ভারতের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য হবে বলে সোভিয়েট ইউনিয়নকে হুঁশিয়ার করে দেওয়া-এ সবই ছিল বাংলাদেশের যুদ্ধে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের জন্য নিক্সন প্রশাসনের বিস্তারিত আয়োজন। ১০ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় হুয়াং হুয়ার সংগ্রামী বিবৃতির পর এই আয়োজন সম্পূর্ণতা লাভ করে। এই সব আয়োজনের মধ্যে তিনটি উপাদান ছিল মার্কিন জনমত তথা রাজনৈতিক অসুবিধা অতিক্রম করার জন্য অত্যাবশ্যক: (১) সাধারণ পরিষদে গৃহীত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের মাধ্যমে ভারতকে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা; (২) এমন কোন দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আশ্রয় নেওয়া যা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে ‘আক্রান্ত পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধে যোগদানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ; এবং (৩) সামরিক হস্তক্ষেপে অংশগ্রহণে চীনকে সম্মত করানো। এই সব ক’টি উপাদান আয়ত্তাধীন হয়েছে বলে মনে করায় কিসিঞ্জার ১১ই ডিসেম্বর ভোরেন্টসভকে চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি জ্ঞাপন করে বলেন, পরদিন মধ্যাহ্নের পূর্বে ভারতকে অবশ্যই যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য করতে হবে, অন্যথায় যুক্তরাষ্ট্র নিজেই প্রয়োজনীয় সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
কিন্তু কিসিঞ্জার নিশ্চয়ই জানতেন, রণাঙ্গনে আসন্ন বিজয় দৃষ্টে ভারত এই চরমপত্র অগ্রাহ্য করবেই। কাজেই মার্কিন প্রশাসন ঐ দিনই কোন এক সময়ে তাদের আসন্ন হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত পাকিস্তানকে জানিয়ে দেন-উপমহাদেশে তখন অবশ্য ১২ই ডিসেম্বর। এই সংবাদের সঙ্গে সঙ্গে CGS লে. জেনারেল গুল হাসান টেলিফোনযোগে পশতু ভাষায় নিয়াজীকে জানিয়ে দেন, পরদিন অর্থাৎ ১৩ই ডিসেম্বরের মধ্যাহ্নে পাকিস্তানী বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য উত্তর ও দক্ষিণ উভয় দিক থেকে বন্ধুরা এসে পড়বে। দক্ষিণের বন্ধু তথা সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগর অবধি আসার জন্য মার্কিন নাগরিক উদ্ধারের যে অজুহাত ব্যবহার করে সেই মার্কিন ও অন্যান্য পাশ্চাত্য নাগরিকদের উদ্ধারকর্ম তিনটি ব্রিটিশ রয়েল এয়ারফোর্সের বিমান কর্তৃক ১২ তারিখেই সম্পন্ন হয়। গুল হাসানের সংবাদের পর ঢাকার সামরিক কর্তৃপক্ষ নিজেদের প্রতিরক্ষার আয়োজন নিরঙ্কুশ করার জন্য চব্বিশ ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারী করে ঘরে ঘরে তল্লাশী শুরু করে। সম্ভবত এই সময়েই কোন পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের আটক করার সিদ্ধান্ত নেয়; পাকিস্তানীদের পরাজয়ের প্রাক্কালে যাদেরকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়।